মাইজদী যখন নোয়াখালী
মাহমুদুল হক ফয়েজ
নোয়াখালীর মত বাংলাদেশে আর এমন কোনো জেলা খুঁজে পাওয়া যাবেনা, যে জেলার আয়তন প্রাকৃতিক ভাবে বেড়ে যাচ্ছে
স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা #### মাহ্মুদুল হক ফয়েজ
মাইজদী যখন নোয়াখালী
মাহমুদুল হক ফয়েজ
নোয়াখালীর মত বাংলাদেশে আর এমন কোনো জেলা খুঁজে পাওয়া যাবেনা, যে জেলার আয়তন প্রাকৃতিক ভাবে বেড়ে যাচ্ছে
ফিচার
‘এই জাল আমগোরে রিজিক দেয়, বাঁচায়’
মাহ্মুদুল হক ফয়েজ
বাংলাদেশের উপকুল ঘেঁষে বাস করে লক্ষ লক্ষ মানুষ । এদের আনেকেই বংশ পরম্পরায় জেলে। জাল আর সাগরের জল এদের জীবনসঙ্গি। উত্তাল ঢেউ ডিঙ্গিয়ে এরা পাড়ি দেয় গহীন সাগরে। সাগরের অথই জলের ঢেউয়ে দোলা খায় তাদের ছোট্ট ছোট্ট মাছ ধরার ডিঙ্গি। দোলা খায় ওদের ছেঁড়াখোঁড়া টোটকা জীবন। প্রকৃতি, সাগর আর আকাশ দেখে দেখে ওরা পথ চলে। এই সাগর কখনো ওদের মায়াবী রোমাঞ্চে কাছে টানে। আবার কখনো রুদ্র রুক্ষতায় ফুলে ফুঁসে ওঠে। সাগরের এই রাগ, অভিমান আর শান্ত স্বভাব ওরা বুঝেশুনে চলে। এদের প্রকৃতি থেকে শিক্ষা নেয়া জ্ঞান ভান্ডারে জমা হযে আছে অফুরন্ত সম্পদ। যুগ যুগ ধরে কুড়ানো এই অভিজ্ঞতার ঝুলিও বেশ ভারী। রামগতির চর আলেকজান্ডারের ইয়াছিন মাঝি । মেঘনার পারেই তার বাড়ি। একেবারে সাগরের মোহনায়। সত্তরের কাছাকাছি বয়স। মেঘনার করাল গ্রাসে কতবার ভেঙ্গে নিযেছে তার বসতভিটা। তবু নদীর কুল ছাড়েনি কখনো। উত্তাল সাগরের ঢেউ আর ইলিশের জাল এখনো বুক চেপে ধরে রেখেছেন তিনি। রামগতির পশ্চিম মাথায় একবোরে নদীর কুল ঘেষে সঙ্গীসাথীদের নিয়ে ইলিশের জাল বুন ছিলেন। লম্বা রেখা ধরে ভেঙ্গে যাচ্ছে গ্রাম। বাড়ীর পর বাড়ী, কারো উঠান,কারো পুকুর। অনেক পুরানো গাছগাছড়া উপড়ে পড়ছে নদীতে। ইয়াছিন মাঝিদের এগুলো গায়ে সওয়া হয়ে গেছে। নদীর ওপারে জেগে উঠেছে চর গজারিয়া। প্রকৃতির কি এক অপরুপ লীলা! ‘ নদীর এ পাড় ভাঙ্গে ও পাড় গড়ে...’। জালের উপর হাত রেখে ইয়াছিন মাঝি বলেন, ‘এই জাল আমগোরে রিজিক দেয়, আমগোরে বাঁচায়’। এক্কেবারে শৈশবেই বাবার হাত ধরে সাগরে নেমেছিলেন তিনি। সাগরের নাড়িনক্ষত্র তাঁর চেনা। সাগরের বান তুফান শুরু হওযার আগেই পশুপক্ষি,কীটপতঙ্গ আর আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি দেখে তারা বানবাদলের আগাম ধারনা করে নেন।
‘যখন পিঁপড়াগুলান সব গাছে উইঠা যায়, তখন আমরা কই - অবস্থা বালা না। মাঝেমাঝে মাটি ফুইরা ছোট ছোট পজ্জা, উলানী উড়তে থাকে। আমরা কই বান তুফান আইতে পারে। তখন দরিয়ায় যাইতে আমরা সাবধানে যাই।’ আল্লা - রসুলের নাম লইয়া আমরা সাগরে মাইধ্যে মাইধ্যে দক্ষিনের সাগর থেইখ্যা বড় বড় দমার (ঢেউ) ছুইটা আসে। তখন এক এক লাহা (ঢেউ) আসে মাথা উচু কইরা। যখন দেখি সাগর বেশী গরম হইয়া গেছে, তখন আমরা মাছের আশা ছাড়ি দেই। তখন জান বাঁচাইবার চেষ্টা করি। খোয়াজ খিজিররে ডাকি। খোয়াজ খিজিরের কাছে মানত করি।’
কি মানত করেন ?
‘শিন্নি মানত করি । মুরগী ছাগল মানত করি।’
অবস্থা খারাপ দেখলে কি করেন ?
‘তখন আমরা জাল গুলিরে সাগরে ফালাইয়া খুইলা দেই। জালের ফুলুটগুলা জাল লইয়া ভাইস্যা থাকে। সাগরের লাহায় আমাগো নাও গুলা উথাল পাতাল করে। তখন আমরা নাও’রে জাল দিয়া বেড়াইয়া লাহার নামনে গিয়া রাখি। জালে আমাগরে বাঁচাই রাখে।
নৌকা ডুবে নাই কোনো সময় ? বিপদ হয় নাই ?
‘হয় মাইধ্যে মাইধ্যে । একবার আমাগো নাও ভাইঙ্গা গেছিলো। চারিদিকে কিচ্ছু দেখা যাইতেছিল না। আমরা বারোজন পড়লাম বিপদে। ফুলুটগুলারে টাইন্যা জালের উপর পা রাইখ্যা বইসা রইছিলাম, ফুলুটগুলারে বগলের নিচে দিয়া ধইরা রাইখছি।
কয়দিন ছিলেন এভাবে ?
‘তিন দিন তিনরাইত আছিলাম। কত মাছে ঠোকরাইছে। বড় বড় মাছে ল্যাজ দিয়া বাড়ি মারছে। পাঙ্গাস মাছে ঠোকরাইয়া গায়ের চামড়া উঠাইয়া ফেলছে। কত আল্লাহরে ডাইকছি তখন। কইছি - আল্লাহ আমাগোরে উদ্ধার কইরা পোলামাইয়া - বৌঝির কাছে নিয়া যাও।’
শেষে কিভাবে বাচলেন ?
তিন দিন তিন রাইত পরে একটা ট্রলার পাশ দিয়া যাইতে আমাগোরে দেইখ্যা তুইলা লইছে। তখন এক্কেরে কাহিল হইয়া গেছিলাম। খাওনের কথা মনে নাই। পানির মাইধ্যে ছিলাম, খাইবার পানি পামু কই। শরীলে তো এমনি পানি পাইছে। সাগরের পানি তো লোনা। বেশী খারাপ যখন লাইগছিলো, তখন জ্বিহবা বাইর কইরা একটু একটু পানির স্বাদ লইছি’। ইয়াছিন মাঝির তিন ছেলে, তিন মেয়ে। ছেলেদের নাম নূরনবী, সোলায়মান, রুহুল আমীন। তিন ছেলেই ইলিশের বোটে থাকে। সবাইকে বিয়ে করিয়েছেন তিনি। তারা সবাই আলাদা সংসার করছে। ছেলে -মেয়ে আছে ওদের। তিন মেয়ে আয়শা খাতুন,অহিদা খাতুন, নারগিস বেগম। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। স্বামীর সংসারে সুখেই আছে তারা। তাদের স্বামীরাও ট্রলারে মাছ ধরে। ইয়াছিন মাঝি থাকে মেঝো ছেলে নুর নবীর কাছে। এক বিয়েই করেছেন তিনি। স্ত্রী মরিয়মেরনেছা বুড়ি হযে গেছেন। কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছেন এখন। ইয়াছিন মাঝির সাথে ট্রলারে মাছ ধরে মোহাম্মদ হোসেন মাঝি, আবদুর রব মাঝি, মোজাম্মেল হক। এদের সবার বয়স চল্লিশ পয়তাল্লিশের মধ্যে। পঁচিশ - ত্রিশ বছর ধরে এরা সাগরে থাকছে। একে অপরের কাছ থেকে এরা শিখছে মাছ ধরার কৌশল। কোন স্কুল কলেজের শিক্ষা ওরা পায়নি। অথচ এক বিশাল জ্ঞানভান্ডারের সমুদ্রে ডুবে আছে। এদের শ্রম-ঘাম-মেধা-জ্ঞানে সাগরের গহীন জল থেকে উঠে আসে রুপালী ইলিশ। ভাগ্যবানরা ভাজা ইলিশের গন্ধ শুঁকে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেন। সর্ষে বাটার ঝোলে ডুব দেয় অথই জলের ইলিশ। ওরা বলেন - ‘আমরা অশিক্ষিত মুরখ্য মানুষ্, সাগরে জাল ফেলি। মাছ ধরি, বেচে খাই। এই জাল আমাগোরে রিজিক দেয়, বাঁচায়’।
জীবন যেমন
সাগরের ভাষা না বুঝলে সাগরে যাওন যায় না
মাহ্মুদুল হক ফয়েজ
সাগর পাড়ের মানুষজন। সাগরের সঙ্গেই আষ্টেপৃষ্ঠে বেধেঁ রেখেছে তাদের জীবন। সাগর ওদের মাঝেমাঝে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কখনও মারে মরণ ছোবল। তবুও সাগরেই ওদের জীবন, সাগরেই ওদের প্রাণ। মেঘনার মোহনায় রামগতির চর আলেকজান্ডারের জাহাঙ্গীর মাঝি। ঠিক নদীর পাড়েই আসলপাড়ায় বাড়ি তার। নদী আর সমুদ্রের সঙ্গে যার আজীবন সখ্যতা। ইলিশের ট্রলার নিয়ে সঙ্গীসাথীহীন ছুটে যায় মাঝ দরিয়ায়। সেই ছোট্র বয়স থেকে চাচা ফজল আহম্মদ মাঝির হাত ধরে সমুদ্র যাত্রা। চাচাই তার ওস্তাদ। এ নদীতে সাধারনত: আষাঢ় - শ্রাবন - ভাদ্র মাসেই ইলিশের মৌসুম। এ বছর তেমন ইলিশ নেই, কি এক অজানা কারনে। শুরুতে জোয়ার এলেই ভাসাতে হবে ট্রলার। যাত্রা হবে আজই । নদীর বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছে বহদ্দারহাটের পাশের জেলেপল্লীতে। রামগতির এ অংশ ভাঙছে তীব্র বেগে। কাদা-জলে আছড়েপড়া নদীর স্রোতে ছলাৎ শব্দ ওঠে। দূর আকাশে ভাদ্রের ছেড়াঁ ছেড়াঁ সাদা মেঘ। দক্ষিনে সমুদ্রের হাওয়া হু হু বয়ে যায়। সাগরসঙ্গমের আকাঙ্খার এই উম্মাত্তাল মাদকতা বয়ে যায় বুঝি এই মাঝিদের দেহ - মনে। জালের ভাজঁ খুলে খুলে আরও ব্যস্ত হয়ে পড়ে জাহাঙ্গীর মাঝি। এখন তার ভরা যৌবন। দেরি তার যেন আর সয় না। সাগর যে তার প্রিয় সখা। দূর সাগর তারে হাতছানি দেয়।
ডর করে না ?
‘ডর কইরবো ক্যান, সাগরে যাইতে হইলে সাগরের ভাষা বুঝন লাগে। সাগরের ভাষা না বুঝলে সাগরে যাওন যায় না।’
জাহাঙ্গীর মাঝি হাসে। এক রহস্যের বন্দরে রসিকতার নোঙর ফেলে যায়।
‘পিরিতের মানুষ কি হগল সময় পিরিতের কথা কয় ? তারে দেইখ্যা বুইঝ্যা শুইন্যা পিরিত না করলে মরণ। সাগরও হে মুইখ্যা’।
কেমন করে সাগরের ভাষা বোঝেন ?
‘সাগরের ভাষা বুইঝতে আমরা পত্থমে চাঁদের হিসাব করি। অমবস্যা- পূর্নিমায় জোয়ারের হিসাব আমগো কাছে আছে। তারপর করি মাসের। কোন মাসে সাগরের হাব- ভাব মন - -মেজাজ কেমন থাকে,বুইজতে হয়। বারিষার বৃষ্টি হয় । সাগরে পানি বাড়ে কিন্তুক গরম হয় না।
কখন গরম হয় ?
‘চৈত্র - বৈশাখ মাসে আর শ্রাবনের শেষ থেইক্যা ভাদ্র আশ্বিন মাসে।’
তখন ক্যামন হয় ?
জাহাঙ্গীর মাঝি একটু যেন গম্ভীর হয়ে উঠল। উত্তর - পশ্চিম কোনে মুখ ফিরিয়ে হাতের ইশারায বলে,
‘ঐখানে কালো মেঘবাসা বাঁধে। পরে সেইখান থেইক্যা দাঁত খিচাইযা ধাইযা আসে। তখন যদি সাগরে জোয়ার থাকে, তয় অসুবিধা কম হয়। জোয়ার তো তখন উত্তর দিকে যায়। বাতাস আসে উত্তর দিক থেইক্যা। আর ঝামিলা হয় ভাটার সময়। তখন আমরা সাবধানে থাকি। এইটা কালবৈশাখি। মাইধ্যে মাইধ্যে দূর থেইক্যা আইসা দূরে মিলাইয়া যায়।’
ভাদ্র -আশ্বিন মাসে বান তুফানে কি করেন ?
‘এই সময়টা বেশী খারাপ। তখন আমরা সাগরের শরীলটা শুঁইকা শুঁইকা চলি। ঊনতাইল্লা গরম পড়লে আমরা বুঝি বিপদ আইতাছে। ভাদ্র মাসের তের তারিখে শীতে খুঁটা গাড়ে। হেইদিন শীতে খুটা গাড়ি কয় - আমি আইতে আছি, তোরা সব খেঁতা বাইর কর। হেই সময় মাইধ্যে মাইধ্যে রাইতে খুব কুয়াশা পড়ে। আবার দিনে পড়ে ঠান্ডা ভাঙা কড়া রইদ। রাইতে শীত,দিনে গরম। আমরা সাবধানে চলি। আবার মাইধ্যে মাইধ্যে দেখি কি - শীত শুরুর আগে উত্তর দিক থেইক্যা গন্ডায় গন্ডায় পাখি দক্ষিনে উড়াল দিতাছে। হেই সময় হঠাৎ করি যদি দেখি, পাখিগুলান আবার উত্তরে উইড়া আইতাছে,তখন আমরা চিন্তায় পড়ি ! কারন পাখিগুলাইন তো এখন আসার কথা নয়। ওরা তো ফিরা যাইবো শীতের পরে। তখন আমরা বুঝি, দক্ষিন দিক থেইক্যা কোন বিপদ আইতাছে। সাগর ফুইলতাছে। আমরা গাঙ্গের তুন কুলে চইলা আসি। আবার আকাশের ভাব দেইখাও মন খোলাশা হইয়া যায়।
সে কি রকম?
‘এই ধরেন, আমাদের সাগরের মুখটা হইল দক্ষিণ পূর্বমুখী। মাঝে মাঝে পূর্ব-দক্ষিণ দিক থেইক্যা কালা মেঘ ধরে। সেটা খুব বিপদ। মাইধ্যে মাইধ্যে এইটা কাইটাও যায় ।
‘সেটা কেমনে কাটে?
‘এই ধরেন, পূর্বে কালা মেঘ ধইরলো। হেই সময় আবার পশ্চিমেও কালা মেঘ আর একটা বাসা বাঁইধলো।
সেটা কি করে!
উইড়া পূর্ব দিকে আইসতে থাকে। আবার পূবেরটাও পশ্চিমে আইসতে থাকে। উপরে আসমানে তারা গুতাগুতি শুরু কইরা দেয়। উপরে উপরে তখন দুইজনে রফা হইয়া যায়, নিষ্পত্তি হয়। এই রকম দুই দিকে যখন কালা মেঘ ধরে, আমরা কই-কিছু হইত না, বিপদ নাই’।
সাগরে ছুটে যাওয়ার জন্য জাহাঙ্গীর মাঝি ব্যস্ত হয়ে ওঠে। এক বিরহী রসিক যেমন তার প্রিয়তমার জন্য উতলা হয়ে ওঠে, জাহাঙ্গীরের ভেতরেও তেমন করে চষ্ণলতা ফুটে ওঠে। জাহাঙ্গীর মাঝি বলে ওঠে-
‘মাইনসের শরীলের থুন যেমন ঘামের গন্ধ কয়, সাগরের শরীলের থুনও ঘামের গন্ধ কয়। সেই ঘামের গন্ধ শুইক্যা আমরা চলি’।
শুধু জাহাঙ্গীর মাঝি নয়। মেঘনার তীরের আঁতর আলী মাঝি, রহমত মাঝি, সোলায়মান মাঝি-এদের সবারই সাগরের সঙ্গে বেড়ে ওঠা। সাগরই ওদের জীবন মরণ। ওদের একজনের হাতে ছোট্ট এক ব্যান্ডের রেডিএকটানা বেজে যাচ্ছিল সেটি। সাগর গরম হলে তো রেডিওতে বলে। শুনেন না?
‘ওটা তো যন্ত্রের বাক্স, যন্ত্রে কথা কয়। আমরা থাকি সাগরের কইলজার মইধ্যে, সাগরের নাড়ি ধইরা সাগরের ভাষা বুঝি। সাগরের কইলজায় কান রাইখ্যা সাগরের গান শুনি।’
Mahmudul Huq Foez
Journalist
|
স্থানীয় বা লোকায়ত জ্ঞান সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ |