স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা #### মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ

বুলেট বিদ্ধ ক্র্যাচ

গল্প

বুলেট বিদ্ধ ক্র্যাচ
মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ

এতদিন কোনো বিষন্নতা মুনিরকে স্পর্শ করতে পারেনি। আর যাই হোক সে জানে অন্ধকার মুখ লুকায় সীমাহীন জ্যোতস্নালোকে। তাই একদিন তার অন্ধকারও মুখ লুকাবে। দু ক্র্যাচের উপর দেহটা খাড়া রেখে ভাবছে মুনির। সামনে ক্যানভাসে বন্ধু মফিজের আঁকা মনিরের প্রেমিকার ছবি। বিশেষ বলে কয়ে এ ছবিটা আঁকিয়ে নিয়েছে সে। পিছনের অন্ধকার ফেলে রেখে আলোকের দিকে তাকিয়ে আছে শীলা। প্রায় বিবস্ত্র দেহ । চোখে অনেক পাওয়ার স্বাদ। যেন সমস্ত কিছু বিসর্জন দিয়ে লাভ করছে স্বর্গীয় অমৃত। মুনিরের দিকে তাকিয়ে বলতে চাইছে; ‘তুমি কি পেলে ? যুদ্ধ করে কী কী পেলে তুমি ? আমিতো পেয়েছি অনেক। বিবস্ত্রা হলাম। ধর্ষিতা হলাম । পেলাম বিরাঙ্গনা উপাধি। আর তুমি! ক্র্যাচে ভর করে অস্পৃশ্য হয়ে আছ।’
চোখটা কেমন যেন ঝাপসা হয়ে অসে। মুখ ফিরিয়ে নিলো মুনির। মাঝে মাঝে তার এমন হয়। প্রেমিকা বিরাঙ্গনা হলো। নিহত হলো। যুদ্ধ করতে গিয়ে নিজের পা-টা হারালো মুনির। তবুও একটা তৃপ্তি যেন এতদিন ছায়া হয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিলো তাকে। তার খোঁড়া শরীরটাকে যেমন করে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলো এতদিন এক জোড়া ক্র্যাচ, তেমনি ক্র্যাচ হয়ে বন্ধু মফিজ দাঁড় করিয়ে রেখেছিলো মনিরের ভাঙ্গা খোঁড়া হৃদয়টাকে। নতুবা অনেক আগেই নূয়ে পড়ে নীচে গড়িয়ে হারিয়ে যেত মনির।
যারা একদিন স্বাধীনতার বিরোধী ছিলো, তারা আজ রাতারাতি ফাও দেশ প্রেমিক সেজে মুঠি মুঠি সম্পদের মালিক হচ্ছে। বাড়ি গাড়ি প্রতাপে আজ তারা ঊর্ধে বহু ঊর্ধে।
আর মুনির! যে ভালোবাসাকে বুকে চেপে ধরে তুলে নিয়েছিলো রাইফেল। বনে জঙ্গলে ঘুরে ধর্ষিতা স্বদেশের ছবি দেখে বার বার জ্বলে উঠেছিলো। সেই ভালোবাসা আজ নিরুদ্দেশ। অথচ মুনিরতো কিছুই চায়নি। সে চেয়েছিলো শুধু তৃপ্তি। ভালোবাসার প্রতিদানে ভালোবাসা। চেয়েছিলো লাল সবুজে ছাওয়া একটা স্বদেশের ক্যানভাস। এতদিন একটা তৃপ্তি পাওয়ার ঠিকানা ছিলো তার। গত রাত থেকে সে ঠিকানাও নেই।
মফিজ ছবি আঁকতো। ছবিতে ফুটিয়ে তুলতো নির্যাতন। চিনিয়ে দিতো সমাজকে। ‘যাদের তোমরা বন্ধু ভাব তাদের পরখ করে দেখ।’ কেউকেটাদের হিংস্র মুখচ্ছবি ফুটে উঠতো তার ক্যানভাসে। এই তার অপরাধ। রাতের আঁধারে সেই মফিজের বুকে বুলেট বিঁধলো। তার রক্তাক্ত অসার দেহ ঢলে পড়লো ক্যানভাসের উপর। রক্তে রক্তে একটা ছাপ হয়ে ফুটে উঠলো দারুন অর্থবহ একটা চিত্র। বুকের রক্তে রঙ বানিয়ে যে ছবি হলো, সে ছবি কথা বললো। অসহয় ভাবে মুনির চোখ রাখলো শীলার চোখের উপর।

আজ মুনিরের কেউ নেই। কেউ নেই। যার কাছে এসে শুনতো ভালোবাসার গান। রাত্রি পোহাবে বলে ভোরের পাখির কাকলী । ক্র্যাচ সেজে যে তাকে দাঁড় করিয়ে রাখতো। মফিজ বলতো, ‘বন্ধু, স্বদেশকে তুমি যা দিয়েছো সেটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া’ সে মফিজ নেই। সে ছিলো মনিরের জন্য একটা অবলম্বন। তার এই কাঠের ক্র্যাচের মত একটা জীবন্ত ক্র্যাচ।

চারদিকে ভীষণ ভীড়। শোকাহত বিপুল জনতা। পুলিশ, সাংবাদিক। সবাই ভীড় করছে। একটা খাটের উপর সাদা চাদর দিয়ে ঢেকে রেখেছে মফিজকে।

শীলার চোখের উপর থেকে মুখ সরাল মুনির। চেয়ে দেখলো মফিজ শুয়ে আছে। আর সেই মূহুর্তে মনির যেন দেখতে পেলো। ও নিহত মফিজ নয়, একটা বুলেটবিদ্ধ রক্তাক্ত ক্র্যাচ সাদা চাদর মুড়িয়ে শুয়ে আছে।


মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ




বুড়ো আলী আজ্জমের মচমচে মুড়ি

ফিচার
বুড়ো আলী আজ্জমের মচমচে মুড়ি
মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ

বৃদ্ধ আলী আজ্জম। এই বয়সেও সারাদিন হেঁটে হেঁটে বিক্রি করেন মুড়ি । নিজের উপর অগাধ বিশ্বাস তাঁর। নিজে যা পারছেন তাই করছেন।
বয়স নব্বই ছাড়িয়ে গেছে। শরীরের চামড়াগুলো থলথলে, ভাঁজ পড়েছে অসংখ্য। পায়ে চপ্পল। পুরনো হয়ে গেছে। ক্ষয়ে ক্ষয়ে পাতলা হয়ে গেছে অনেকটা। চলতে চলতে চপ্পল মৃদু শব্দ ওঠে। গায়ে আধময়লা গেঞ্জি। এক পাশটা ছিড়েঁ ঝুলে পড়েছে অনেকটা। মাথায় বেশ বড় বড় ঢাউস বস্তা। মাইজদীর এই মফস্বল শহরে ভাঙ্গাগলি মাড়িয়ে টানা টানা স্বরে হাঁক দেন -
‘মুড়ি.ই.ই.ই.ই.... মুড়ি লাগবো...ও.ও.ও....... মুড়ি...ঈ.ঈ.ঈ......


বৃদ্ধ আলী আজ্জম। সারাদিন কারও ওপর নির্ভর না করেই শরীরটাকে টেনে নিয়ে যান সামনে।

কেউ নেই !
আছে। পোলা, মাইয়া, বৌ -ঝি আছে।
ছেলেরা দেখাশুনা করে না !
সারা শরীর থেকে ঘাম ঝড়ছিল বুড়োর। খাড়া নাক। তীক্ষ্ণ খাড়া নাকের ডগা থেকে ঘাম ঝরছিল টপ টপ করে। তীব্র উজ্জল দুটি কঠিন চোখে তাকায় বুড়ো - হাতের তালুতে ঘাম ঝাড়েন। নড়েচড়ে বসে বলেন -
ওগোরে লই ওরা আছে। হেগো খানা আমি খামু ক্যান । আমার তো এখনো গতর আছে।
কয় ছেলে আপনার ?
‘তিন ছেলে। দুই পোলা বদলা মুইয়া দেয়। বিয়া করাইছি। হেরা হেগোরে লই থাকে। ছোটটারে আইএ পর্যন্ত পড়াইছি। নোয়াখালী কলেজের তুন পরীক্ষা দিছিল। পাস কইত্তো পারেনো। এখন এই টুকটাক নারিকেলে - সুপারির ব্যবসা করে। হেটা আমার কাছে থাকে।
নোয়াখালী শহরের পাশেই রাজগঞ্জের তেতুঁইয়া গ্রামে বাড়ী আলী আজ্জমের। বাবা আইয়ুব আলী সৈয়ালের কাজ করতেন।‘৬২ সালে মারা গেছেন। বাবার রেখে যাওযা ভিটিতেই থাকেন আলী আজ্জম। একেবারে শৈশবে মাত্র নয় বছর বয়স থেকেই শুরু করেছের ব্যবসা। নানা রকমারি ব্যবসা। মাছের পোনা বিক্রি। ধান চালের ব্যবসা। তারপর শেষে ধরেছেন এই মুড়ির ব্যবসা ত্রিশ বছরেরও বেশি সময়ে ধরে এই ব্যবসা করছেন। পান- খাওয়া পাতলা ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে কালচে দাঁত নড়েচড়ে ওঠে। অসাধারন এক দৃপ্ত স্বরে বলেন -
’আমি কোনদিন কারও অধীনে ছিলাম না। স্বাধীনভাবেই চইলা আইছি। পরনির্ভর আমি না'। অসম্ভব দৃঢ়তা ফুটে ওঠে তাঁর চোয়ালে। পাকা পাতলা দাঁড়ির ফাঁকে কঠিন চোয়ালের ওপর নীল মোটা রগের রেখা ফুটে ওঠে। আপনার বৌ কি আছে এখনো ?
‘হ’ আছে । এখন আর বেশী কাজ কইত্ত পারে না। বুড়ো অই গেছে ।’
কত বছর বয়সে বিয়ে করেছেন ?
আমার তখন ষোল বছর ছিল’ ।
একটু যেন আনমনা হয়ে ওঠেন। হয়তো ঠিক এই সময়ে সুদূর অতীতের জীবনের শুরুর কোন রোমাঞ্চকর সুখকর স্মৃতি আবছা ধরা পড়ছিল। সে মুহুর্তটি বেশিক্ষণ থাকল না তাঁর।
মুড়ি কোত্থেকে কেনেন ?
‘রামগতি, চরবাটা, চরলক্ষীর চরের থুন।’
ধান কিনে ঘরে মুড়ি ভাঙ্গেন ?
‘না। বাড়ি বাড়ি যাই মুড়ি কিনি। ঘিগজ ধানের মুড়ি। এই ধানের মুড়ি বালা। খাইতে স্বাদ। মচমইচ্চা।’
মাইজদী শহর থেকে বিশ পঁচিশ কিলোমিটার দূরে গ্রামে গ্রামে ঘুরে তিনি নিজেই মুড়িগুলো দেখে শুনে কেনেন। মাইজদী বাজারে একটি ঘর ভাড়া নিয়েছেন। একশ’দশ টাকা ভাড়া দেন মাসে। মুড়িগুলো বিভিন্ন জায়গা থেকে কিনে এনে এখানে রাখেন। তারপর সেখান থেকে বস্তায় ভরে দাড়িপাল্লা নিয়ে বের হন শহরে। মন হিসাবে কিনে আনেন। বিক্রি করেন কেজি মাপে। প্রতি কেজিতে আড়াই থেকে তিন টাকা লাভ হয়। শেষবার মন কিনলেন এগারশ’ পঞ্চাশ টাকায়। বিক্রি প্রতি কেজি করলেন পয়ঁত্রিশ টাকায়।
প্রতিদিন কত কেজি বিক্রি করেন ?
‘পঁচিশ ত্রিশ কেজি।’
আপনার বৌ মুড়ি ভাজে না ! তাহলে তো আরো বেশী লাভ হতো। নিজে ভাজলে খরচ তো কম পড়তো।
পড়তো হয়তো। একটু নরম সুরে বললেন - ‘আগে ভাজতো এখন পারে না’।
একটা স্নেহার্ত সুর বেজে উঠে তাঁর কন্ঠে। শহরে ক’টি নির্দিষ্ট বাড়িতে তাঁর নিয়মিত গ্রাহক আছে। গৃহবঁধুরাই তাঁর কাছ থেকে বেশী মুড়ি কেনে।
লাভ এর চেয়ে বেশী করতে পারেন না ?
ক্ষেপা সুরেই বলে উঠলেন, ‘লাভ কইরলে তো কইত্তে পারি। ভেজাল দিলে তো লাভ হয়, কিন্তুক আল্লাহর কাছে ঠেকা থাকুম। আর হের্‌কুম কইত্তামওবা কিয়ের লাই। ইন্ডিয়ার এক কিসিম চাইল আছে। ভেজাইল্লা চাইল। দাম মেলা কম। হেগুন দি ভাইঙলে মেলা লাভ হয়। আঁর হেই লাভের দরকার নাই’।

মুড়ি বাঙালি সমাজে এক জনপ্রিয় খাদ্য। সে স্থান দখল করে নিচ্ছে নানা সুসজ্জিত মোড়কের বিস্কুট। নানান মুখরোচক প্রচারনায় আকৃষ্ট করেছে গ্রাহককে। লাভের পাহাড় গুনছে কেউ কেউ। বুড়ো আলী আজ্জম সেই লাভের পাহাড় দেখেন না। খাঁটি আর নির্ভেজাল মুড়ি গ্রাহকের হাতে তুলে দিতে পারলেই যেন তাঁর তৃপ্তি। বৃষ্টি বাদলের দিনে অথবা কোন রোদেলা দুপুরে ঘর্মাক্ত শরীরে কারো দোর গোড়ায় এই মুড়ি পৌঁছে দিতে পারলেই যেন তাঁর স্বস্তি। মফস্বল শহরে ইঁটের সুরকি ওঠা খিঁচড়ি খেউড়ে গলির রাস্তায় হেঁটে যান বৃদ্ধ আলী আজ্জম। তখন হয়তো কোন বাড়ির কোন কুলবধূ আধো ঘোমটা উচিঁয়ে দরজার ডালা মেলে মুড়ির জন্য অপেক্ষা করে। দাওয়ায় এসে বুড়ো হাঁক দেন -
‘মুড়ি লাইগবোনি মা, মুড়ি। মচমচে মুড়ি।’

মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ



আমাদের নোয়াখালী







আমাদের নোয়াখালী
মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ




গাঙ্গেয় পলিমাটি সমৃদ্ধ উপকূলীয় জেলা নোয়াখালী। এ উর্বর অঞ্চল এক সময় সমতট নামে সুপরিচিত ছিলো। সহস্র বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সাথে যোগাযোগের কারণে ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিলো এ অঞ্চল। পত্তন হয় ভুলুয়া ষ্টেটের। সে থেকে ভুলুয়া পরগণা হিসেবেই এ অঞ্চল প্রসিদ্ধি লাভ করে। ভুলুয়া বন্দরের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়। শিক্ষা দীক্ষা, জ্ঞানে মানে এলাকার মানুষ প্রভুত উন্নতি লাভ করে। মেঘনার মোহনায় সমুদ্রের উদার স্পর্শে এ এলাকার মানুষগুলো হয়ে উঠে উদার হৃদয়, আতিথি পরায়ণ আর কর্মঠ। বিক্ষুব্ধ সাগর ডিঙ্গিয়ে এদেশের মানুষ পাড়ি দিয়েছিলো দেশ বিদেশে। স্বভাবেও এ অঞ্চলের মানুষ স্বাধীন চেতা ও দৃঢ় চিত্তের আধিকারী। নানা দেশের সূফী দরবেশ আর জ্ঞানীদের আগমন ঘটেছিলো এই অঞ্চলে। কাল ক্রমে এর নাম করণ করা হয় নোয়াখালী। আরবীয় ইংরেজ আর গ্রীক সভ্যতার মিশ্রনে নোয়াখালী শহর গড়ে উঠেছিলো এক অপরুপ রুপসী সাজে। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই আবিশ্বাস্যভাবে ভাঙ্গন শুরু হয় এ জনপদের। মাইলের পর মাইল সেই ঐতহ্যবাহী জনপদ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। সেই সাথে বিলীন হয়ে যায় হাজার বছর ধরে গড়ে উঠা সমৃদ্ধশালী ঐতিহ্যের চিহ্ন। ছিন্ন ভিন্ন হয়ে পড়ে কোলাহলময় এ লোকালয়। বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায় অসংখ্য গৌরব গাঁথা অধ্যায়। ভাঙ্গাগড়ার অমোঘ বাত্যাবয়নে জেলার ভৌগোলিক ইতিহাসও বাঁক নিয়েছে নানান ভাবে। তবুও কখনো থেমে থাকেনি এর চলার গতি। এখন এই জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে চট্টগ্রাম বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। বর্তমান নোয়াখালী জেলা একসময় ফেনী, লক্ষীপুর এবং নোয়াখালী জেলা নিয়ে একটি জেলা বা বৃহত্তর অঞ্চল ছিল, যা এখনও বৃহত্তর নোয়াখালী নামে পরিচিত।
ইতিহাস
নোয়াখালী জেলার প্রাচীন নাম ছিল ভুলুয়া। নোয়াখালী সদর থানার আদি নাম সুধারাম। নোয়াখালী নামের উত্পত্তি নিয়ে নানা জনের নানান মত রয়েছে। তবে ইতিহাসবিদদের ভিতর সবচেয়ে যে মতটি প্রচলিত তা হলো. একবার ত্রিপুরা-র পাহাড় থেকে প্রবাহিত ডাকাতিয়া নদীর পানিতে ভুলুয়া-র উত্তর-পূর্বাঞ্চল ভয়াবহভাবে প্লাবিত হয় ও ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসাবে ১৬৬০ সালে একটি বিশাল খাল খনন করা হয়, যা পানির প্রবাহকে ডাকাতিয়া নদী হতে রামগঞ্জ, সোনাইমুড়ী ও চৌমুহনী হয়ে মেঘনা এবং ফেনী নদীর দিকে প্রবাহিত করে। এই বিশাল নতুন খালকে নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় "নোয়া (নতুন) খাল" বলা হত, এর ফলে "ভুলুয়া" নামটি একসময়ে পরিবর্তিত হয়ে ১৬৬৮ সালে হয়ে যায় "নোয়াখালী"।
নোয়াখালীর ইতিহাসের অন্যতম ঘটনা ১৮৩০ সালে নোয়াখালীর জনগণের জিহাদ আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ ও ১৯২০ সালের খিলাফত আন্দোলন। বৃটিশ ভারতের শেষ দিকে নোয়াখালীর রামগঞ্জে এক ভয়াবহ জাতিগত দাঙ্গা সংঘটিত হয়। সে দাঙ্গা বা রায়টের পর ১৯৪৬ সালে
মহাত্মা গান্ধী নোয়াখালীতে আগমণ করেন। এখানে তিনি জাতিগত শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য গ্রামে গ্রামে ক্যাম্প স্থাপন করেছিলেন। বর্তমান সোনাইমুড়ি উপজেলার জয়াগ নামক স্থানে গান্ধীজির নামে একটি আশ্রম রয়েছে, যা "গান্ধী আশ্রম" নামে পরিচিত।
১৭৯০ সালের পর হতে নোয়াখালী জেলা বহুবার ঘুর্ণিঝড়, বন্যা, টর্নেডো, সাইক্লোন ইত্যাদি বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে পতিত হয়।
১৯৭০ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে নোয়াখালী উপকূল লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিলো। তখন সমগ্র উপকূলে প্রায় ১০ লক্ষ লোকের প্রাণহানি ঘটে।
১৯৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামে পাক হানাদার বাহিনীর সাথে বহু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে নোয়াখালীর মাটি রঞ্জিত হয়ে আছে। সে সময়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী নিরিহ নিরস্ত্র মানুষকে বিভিন্ন ক্যাম্পে ধরে নিয়ে অকথ্য নির্যাতনের পর হত্যা করে। এছাড়াও বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক গণহত্যা চালায়। ১৯৭১ এর ১৫ই জুনে সোনাপুর আহমদীয়া স্কুল সংলগ্ন শ্রীপুরে নিরিহ গ্রামবাসীর উপর অতর্কিত এসে হামলা করে মেশিনগান চালিয়ে প্রায় শতাধিক নারী পুরুষকে হত্যা করে। এ সময় তারা শুধু মানুষ হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, সমগ্র গ্রামটিও তারা জ্বলিয়ে দিয়েছিলো। ১৯৭১ সালের ১৯ আগস্ট পাকবাহিনী বেগমগঞ্জ থানার
গোপালপুরে গণহত্যা চালায়। নিহত হন প্রায় ৫০ জন নিরস্ত্র মানুষ। ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর বীর মুক্তিযোদ্ধারা আসীম সাহসিকতায় যুদ্ধ করে নোয়াখালী জেলা শত্রু মুক্ত করে।
ভৌগলিক সীমানা
চট্টগ্রাম প্রশাসনিক বিভাগের অধীন নোয়াখালী জেলার মোট আয়তন ৩৬০১ বর্গ কিলোমিটার। নোয়াখালী জেলার উত্তরে
কুমিল্লা, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে ফেনীচট্টগ্রাম জেলা এবং পশ্চিমে লক্ষীপুরভোলা জেলা অবস্থিত। বছরব্যাপী সর্বোচ্চ তাপমাত্রার গড় ৩৪.৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রার গড় ১৪.৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস। বছরে গড় বৃষ্টিপাত ৩৩০২ মিমি। এই জেলার প্রধান নদী বামনি এবং মেঘনা
প্রশাসনিক এলাকাসমূহ

নোয়াখালী জেলায় ৯ টি উপজেলা রয়েছে। এগুলো হলো:
নোয়াখালী সদর, বেগমগঞ্জ, চাটখিল, কোম্পানীগঞ্জ, হাতিয়া, সেনবাগ, কবির হাট, সুবর্ণ চরসোনাইমুড়ি
নোয়াখালীর শহর
নোয়াখালী সদর মাইজদি ৯টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত। আদম শুমারীর সর্বশেষ তথ্য আনুযায়ী শহরের মোট জনসংখ্যা ৭৪,৫৮৫; এর মধ্যে ৫১.৫০% পুরুষ এবং ৪৮.৫০% মহিলা; জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৫৯১৫। শহুরে লোকদের মধ্যে শিক্ষিতের হার প্রায় ৬০.৭০%। নোয়াখালী সদরের আদি নাম সুধারাম। ১৯৪৮ সালে যখন
উপজেলা সদর দফতর মেঘনা গর্ভে বিলীন হয়ে যায়, তখন তা ৮ কিলোমিটার উত্তরে সরিয়ে বর্তমান মাইজদিতে স্থানান্তর করে হয়। তখন থেকে সম্পুর্ন নতুন ভাবে গড়ে উঠে নোয়াখালী শহর যা 'মাইজদী শহর' নামেও পরিচিত।
চৌমুহনী নোয়াখালীর আরেকটি ব্যস্ত শহর ও বাণিজ্য কেন্দ্র, যা একসময়ে মুদ্রণ ও প্রকাশনা ব্যবসার জন্য বিখ্যাত ছিল। সরিষার তেলের মিলের জন্যও সমগ্র দেশে এ বানিজ্য কেন্দ্রটির সুখ্যাতি ছিলো।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বসুরহাট শহরটি দ্রুত বেড়ে উঠছে এবং এটি এখন একটি ব্যস্ত শহরের রুপ নিচ্ছে । এই শহরের অধিবাসীদের একটি বড় অংশ কাজের জন্য আমেরিকা কিংবা মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী। এ অঞ্চলের যুগদিয়াতে এক সময় একটি ব্যাস্ত নৌবন্দর ছিলো যা বৃটিশ ভারতে লবণের জন্য প্রসিদ্ধ ছিলো। এখান থেকেই জাহজ বোঝাই হয়ে পাট এবং লবণ ইংল্যান্ডে রফতানী হতো। জনশ্রুতি আছে এখানে এক সময় যুদ্ধ জাহাজ তৈরী হতো এবং তা সারা বিশ্বে রফতানী হতো।
অর্থনীতি
বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা যায়, নোয়াখালী জেলার মোট আয় ৩৭৮ কোটি টাকা (১৯৯৯-২০০০)। জেলার মোট আয়ের ৪৮% আসে চাকরি বা সেবামূলক খাত থেকে। অপরদিকে আয়ের মাত্র ১৭% আসে শিল্পখাত থেকে। নোয়াখালী জেলার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রায় ৬ শতাংশ হারে হচ্ছে। নোয়াখালী জেলার মানুষের মাথা পিছু আয় ১৩,৯৩৮ টাকা (১৯৯৯-২০০০)। এ জেলার বিপুল সংখ্যক মানুষ মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকা সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে। তাদের পাঠানো বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা জাতীয় আয়কেও সমৃদ্ধ করছে।
চিত্তাকর্ষক স্থান
নোয়াখালী জেলার দক্ষিণে অবস্থিত
নিঝুম দ্বীপ দর্শনীয় স্থান হিসাবে দিন দিন খ্যাতি লাভ করছে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ভেন্যু উপযোগী শহীদ ভুলু স্টেডিয়াম, দৃষ্টি নন্দন বজরা শাহী মসজিদ, সোনাপুরে লুর্দের রাণীর গীর্জা, উপমহাদেশ খ্যাত সোনাইমুড়ির জয়াগে অবস্থিত গান্ধি আশ্রম, নোয়াখালীর উপকূলে নতুন জেগে উঠা চরে বন বিভাগের সৃজনকৃত ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, মাইজদী শহরে অবস্থিত নোয়াখালী জেলা জামে মসজিদ , নোয়াখালী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, মাইজদী বড় দীঘি, কমলা রাণীর দীঘি, হরিণারায়ণ পুর জমিদার বাড়ি প্রভৃতি দর্শনীয় স্থান হিসাবে উল্লেখযোগ্য।
উল্লেখযোগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
শিক্ষাদীক্ষায় নোয়াখালীর সুখ্যাতি বহু দিনের। সুদুর অতীতকাল থেকেই নোয়াখালী আঞ্চলের মানুষ জ্ঞান লাভের উদ্যেশে দেশ বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলো। তখন থেকেই এ আঞ্চলে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। কর্তমানেও অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষা ক্ষেত্রে সুনাম অর্জন করে চলছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য -
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় -সোনাপুর নোয়াখালী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় -মাইজদি, সোনাপুর ডিগ্রি কলেজ - সোনাপুর, অরুণ চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় - মাইজদি বাজার, হরিণারায়ন পুর উচ্চ বিদ্যালয় - হরিণারায়নপুর, নোয়াখালী সরকারি কলেজ, বিদ্যানিকেতন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় - মাইজদি বাজার, জেলার অন্যতম প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নোয়াখালী জিলা স্কুল , ব্রাদার আন্দ্রে উচ্চ বিদ্যালয় - সোনাপুর, পৌর কল্যাণ উচ্চ বিদ্যালয় - মাইজদী,এম এ রশিদ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় - মাইজদী, আহমদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়, সোনাপুর, নোয়াখালী আইন মহাবিদ্যালয় - মাইজদী, নোয়াখালী পাবলিক কলেজ - মাইজদী, চৌমুহনী মদন মোহন উচ্চ বিদ্যালয় - চৌমুহনী, বেগমগঞ্জ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় - বেগমগন্জ, গণিপুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় - গণিপুর, চৌমুহনী, চৌমুহনী সরকারি সালেহ আহমেদ কলেজ - চৌমুহনী, চৌমুহনী টেকনিক্যাল স্কুল, নোয়াখালী কৃষি ইন্সিটিউট - বেগমগঞ্জ, টেক্টাইল ইন্সটিটিউট, নোয়াখালী যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ট্যাকনিক্যাল ইন্সটিট্উট, গাবুয়া। মাইজদী ম্যাডিক্যাল এ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেইনিং স্কুল। বসুরহাট সরকারি মুজিব কলেজ- কোম্পানীগঞ্জ, বসুরহাট সরকারি এ এইচ সি উচ্চ বিদ্যালয়, বসুরহাট ইসলামিয়া সিনিয়র আলীয়া মাদ্রাসা, কোম্পানীগঞ্জ মডেল স্কুল (কেজি), বামনী আছিরিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা, , কামাল আতাতুর্ক হাই স্কুল, দাগনভূঁয়া, কবির হাট কলেজ, হাতিয়া ডিগ্রি কলেজ, হাতিয়া হাই স্কুল, প্রভৃতি।নতুন ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নোয়াখালী মেডিকেল কলজ
উল্লেখযোগ্য সংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান
জেলার অন্যতম প্রধান সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র -
নোয়াখালী জেলা শিল্পকলা একাডেমি শিশু কিশোরদের শিল্প সংস্কৃতি প্রশক্ষণ কেন্দ্র- নোয়াখালী শিশু একাডেমি, নোয়াখালী মৌমাছি কচিকাঁচার মেলা, নোয়াখালী জেলা উদীচী শিল্পি গোণ্ঠী, নোয়াখালী জেলা উদীচী কর্তৃক পরিচালিত আলতাফ মাহমুদ সংগীত বিদ্যালয়, ললিতকলা সংগীত বিদ্যালয়, মোহাম্মদ হাসেম সংগীত বিদ্যালয়। এছাড়াও প্রত্যেক উপজেলায় রয়েছে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান।
নোয়াখালী থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্র
নানান সীমাবদ্ধতার ভিতরে
নোয়াখালী সংবাদ পত্র গুলো প্রকাশিত হয়। তবে কোনো পত্রিকাই এখন পর্যন্ত নিয়মিত প্রকাশ হচ্ছেনা। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবই এর প্রধান কারণ। তবুও অনেক বাধাবিপত্তি সত্তেও কিছু পত্রিকা অনিয়মিত হলেও প্রকাশিত হয়ে আসছে। তার মধ্যে উল্লখযোগ্য, দৈনিক জাতীয় নিশান, দৈনিক জনতার অধিকার, দৈনিক জাতীয় নূর, পাক্ষিক লোকসংবাদ, নোয়াখালী কন্ঠ, নোয়াখালী মেইল, সাপ্তাহিক চলমান নোয়াখালী প্রভৃতি
অনলাইন পত্রিকা
আধুনিক বিশ্ব তথ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। নোয়াখালীও এর থেকে পিছিয়ে নেই। তথ্যপ্রযুক্তির এ প্রসারের যুগে নোয়াখালীতে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু তথ্য প্রযুক্তি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।এখান থেকে বিপুল সংখ্যক তরুণ প্রজন্ম কম্পিউটার শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর অনলাইন পত্রিকা। বেশ কিছু অনলাইন পত্রিকা অন লাইনে নিয়মিত প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে সবচেয় জনপ্রিয় ও বহুল পঠিত পত্রিকা 'নোয়াখালী ওয়েভ'। এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম অনলাইন পত্রিকা। দেশ বিদেশের বিপুল সংখ্যক পাঠক এ সাইটটি নিয়মিত ভিজিট করছেন। দিন দিন এর পাঠক সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
উন্নয়ন সংগঠন
নোয়াখালীতে বেশ কিছু বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা স্থানীয় উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখছে। তাদের মধ্যে অন্যতম,
গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট, নোয়াখালী পল্লি উন্নয়ন সংস্থা-এন.আর.ডি.এস, বন্ধন, রিমোল্ড, পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশন নেটওয়ার্ক- প্রান, সাগরিকা, দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থা, উপমা, এনরাস, ঘর, তথ্য প্রযুক্তি প্রসারে কর্মরত-দিগন্তের ডাক প্রভৃতি।
নোয়াখালীর উন্নয়নে সম্ভাবনা
খুবই ধীর গতিতে নোয়াখালীর উন্নয়নের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। এজেলায় কোনো বড় শিল্প কারখানা নেই। তবে বর্তমানে কিছু শিল্প গোষ্ঠী এ জেলায় শিল্প প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে এসেছে। এখানের উন্নয়নের সবচেয়ে বড় বাধা জেলার ভয়াবহ জলাবদ্ধতা। বছরের প্রায় অর্ধক সময় জেলার অধিকাংশ এলাকা জলমগ্ন থাকে। তাই উন্নয়নের কাজও বাধাগ্রস্ত হয়। এর জন্য নোয়াখালী খালই প্রধান দায়ি বলে অনেকে মনে করেন। এ খাল সঠিকভাবে খনন করতে পারলে যেমন জলাবদ্ধতা দূর হবে তেমন করে কৃষি উন্নয়নেও এর ভূমিকা থাকবে। তাছাড়া এ খালের পানি প্রবাহকে কাজে লাগিয়ে নৌ-যোগাযোগ ও পর্যটন শিল্পও প্রসার ঘটবে। ইতিমধ্যই জেলায় কিছু উন্নয়নের কাজ হাতে নেয়া হয়েছ। এর মধ্যে নোয়াখালী-লাকসাম সড়কটি প্রসস্ত করা হচ্ছে, নোয়াখালী মেডিকেল কলেজের কর্মসূচীও এ বছর থেকে শুরু হয়েছে। সোনাপুর থেকে চরজব্বর পর্যন্ত রেল লাইন সম্প্রসারনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। নিঝুমদ্বীপকে ঘিরে একটি ব্যাপক পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য নানান সময় বিভিন্ন মহল থেকে দাবী উঠেছে। প্রকৃতির অপার কৃপায় নোয়াখালীর দক্ষিনে সাগর থেকে জেগে উঠছে বিপুল পরিমান নতুন নতুন ভূমি। সঠিক ভাবে এ ভূমিগুলো কাজে লাগিয়ে এলাকায় ব্যাপক উন্নয়নের পরিকল্পনা গ্রহন করা যায়।

মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ

৭ ডিসেম্বর নোয়াখালী মুক্তদিবসের স্মৃতি

৭ ডিসেম্বর নোয়াখালী মুক্তদিবসের স্মৃতি
মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ

মহান মুক্তিযুদ্ধে অকুতভয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে ছিনিয়ে এনেছিলেন আমাদের গৌরবময় স্বাধীনতা। নিজের জীবন তুচ্ছ করে বাংলার শ্যামল প্রান্তরে রাজাকার আলবদর বাহিনীর সাথে একই ভাবে লড়ে গিয়েছিলেন তাঁরা। নোয়াখালীতেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। একাত্তরের ৭ ডিসেম্বর বীর মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের কাছ থেকে মুক্ত করেছিলেন নোয়াখালীর জেলা সদর। ২৬মার্চ যুদ্ধ শুরুর পূর্বেই নোয়াখালী বাসী স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলো। বস্তুত ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্সের ঐতিহাসিক ভাষনের পর পরই জেলাবাসী প্রস্তুত হতে থাকে একটি সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য। বিশেষ করে ছাত্র যুবক তরুণদের মাঝে ছিলো ব্যাপক উদ্দমতা। সে সময় শহর ও গ্রামের আনাচে কানাচে ছাত্র যুবকরা নিজেরাই নিজেদের উদ্যোগে গড়ে তুলেছিলো স্বেচ্ছাসেবক টিম। বাঁশের লাঠি দিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণও শুরু হয়ে গিয়েছিলো। যদিও সেগুলো সামরিক কোনো প্রশিক্ষণের আওতার মধ্যে পড়েনা। কিন্তু মনের মধ্যে যে বিপুল চেতনার সম্মিলন পঞ্জিভুত হয়েছিলো তার তুলনা আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবেনা।
২৬ মার্চ থেকে প্রায় এক মাস নোয়াখালী জেলা সদর হানাদার মুক্ত ছিলো। সে সময় জেলার মুক্তিযোদ্ধারা সংঘটিত হবার ব্যাপক সুযোগ পায়। সে সময় ফেনী, লক্ষীপুর আর নোয়াখালী মিলে ছিলো এটি জেলা। ফেনী ছিলো সীমান্তবর্তী অঞ্চল। জেলায় যুদ্ধের দামামা সেখানেই প্রথম শুরু হয়। নোয়াখালী শহরের প্রাণ কেন্দ্র ছিলো টাউন হল। জেলার রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক নানান ঘটনার নীরব স্বাক্ষী। সেই টাউন হলেই প্রতিষ্ঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র বা সদর দফতর। সেই সদর দফতর পরিচালনা যাঁরা করেছিলেন তাঁরা আজ সবাই প্রয়াত। তাঁদের মধ্যে ছিলেন জননেতা আব্দুল মালেক উকিল, সহিদ উদ্দিন এস্কেন্দার(কচি), আব্দুল মালেক(শ্রীপুর), মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন শহীদ সাহাব উদ্দিন এস্কেন্দার(ভুলু) প্রমুখ।
সে সময় জেলার অগুনিত তরুণ স্বত:স্ফূর্ত ভাবে এখানে এসে মুক্তিযুদ্ধে নাম লিখিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলো আনেক আনসার আর অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর লোক। তখন ফেনীতে পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ করতে ট্রাকে করে এখান থেকে মুক্তি যোদ্ধারা ছুটে গিয়েছিলো ফেনীতে। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়ার জন্য গ্রামবাসীরা যে যা পেরেছে রুটি চিড়া গুড় আর শুকনো খাবার নিয়ে ছুটে এসেছিলো নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে। সে সময় সেগুলো ছিলো এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।
যুদ্ধ শুরুর সময় নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক ছিলেন মঞ্জুরুল করিম। তিনি সে সময় মুক্তিযুদ্ধাদের সর্বত্বক সহযোগীতা করেছিলেন। এ জন্য পাকিস্তানীদের কাছ থেকে তাঁকে অনেক খেসারতও দিতে হয়েছিলো। যুদ্ধকালীন সময় তিনি নোয়াখালী থেকে বদলী হয়ে যান এবং তাঁর পরিবর্তে জেলা প্রশাসক হয়ে আসেন খানে আলম খান। জেলা মুক্ত হওয়া পর্যন্ত তিনি নোয়াখালীতেই কর্মরত ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় বৃহত্তর নোয়াখালীর মুজিব বাহিনীর প্রধান ছিলেন মাহ্‌মুদুর রহমান বেলায়েত। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ছাত্র যুবকদের সংঘটিত করে ভারতের দেরাদুনে গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং গ্রহণ করেন। আন্যদিকে সুবেদার লুৎফুর রহমানের নেতৃত্বে গড়ে উঠে সামরিক বাহিনী থেকে আসা যুব জনতা নিয়ে গঠিত মুক্তিযোদ্ধা দল। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস মুক্তিযোদ্ধারা অসীম সাহসে দখলদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। যুদ্ধে অনেকেই শহীদ হন। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ ডাকসুর সমাজ কল্যান সম্পাদক ছিলেন অহিদুর রহমান অদু। মুক্তিযুদ্ধে তিনি নোয়াখালী সদরের মুজিব বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। শত্রু মুক্ত হওয়ার মাত্র কয়দিন আগে চাপরাশির হাটে এক সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন তিনি। সাহাব উদ্দিন এস্কেন্দার ভুলু পাকিস্তানীদের হাতে বন্দী হয়ে হানাদারদের অমানুষিক নির্যাতনে শহীদ হন। চৌমুহনী কলেজের ছাত্র সালেহ আহমেদ মজুমদার এক সম্মুখ সমরে শহীদ হন। নোয়াখালী মুক্ত হওয়ার অনেক অগেই মুক্তিযোদ্ধারা ঘিরে ফেলে নোয়াখালী শহরের চতুর্দিক। শহর আক্রমনের অগে বেশ কিছু রেকি টিম অত্যন্ত গোপনে শত্রুর উপর নজরদারী করে যায়। ৬ তারিখ রাতের মধ্যেই সমস্ত প্রস্তুতি শেষ হয়। জেলা প্রশাসক খানে আলম খানকে শহর আক্রমন করার পরিকল্পনার কথা অগে ভাগেই অভিহিত করা হয়। এ সময় রাজাকার আলবদরদের ফেলে আবার ফিরে আসার মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে পাকিস্তানী বাহিনী গোপনে কুমিল্লা কেন্টনমেন্টের দিকে পলায়ন করে। হানাদারদের প্রধান ঘাঁটি ছিলো মাইজদী পিটিআই ভবন এবং সে সময়ে নির্মিতব্য সদর হাসপাতাল। এ ছাড়াও আরো কয়টি ছোট ছোট ঘাঁটি ছিলো তাদের। তার মধ্যে শহরের পূর্ব পাশে মাইজদী কোর্ট রেল ভবন ও নাহার বিল্ডিং ছিলো অন্যতম। সে ঘাঁটি গুলোর আগেই পতন হয়েছিলো।
৭ ডিসেম্বরে এলো সে মাহেন্দ্রক্ষণ। ভোরের সূর্য উঠার অনেক আগেই মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের শেষ ঘাঁটি মাইজদী পিটিআই আক্রমন করে। সে সময় সেখানে শুধু রাজাকার আলবদররাই অবস্থান করছিলো। তাদের শেষ আশা ছিলো পকিস্তানীরা এসে তাদের উদ্ধার করবে। সে ভবনটি যখন ঘিরে রাখা হয়েছিলো তখন তাদেরকে বার বার বলা হচ্ছিলো আত্মসমর্পন করার জন্য। কিন্তু তারা তা কর্ণপাত না করে উৎসুক জনতার দিকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুঁড়তে থাকে। তাদের সে গুলিতে তখন অনেক নিরিহ গ্রামবাসি নিহত ও আহত হয়েছিলেন। এক পর্যায়ে আর কোনো উপায় না দেখে রাজাকার আল বদররা একে একে আত্মসমর্পন করতে করতে ভবন থেকে বের হয়ে আসে। দুপুরের মধ্যেই পতন হয় শত্রুর শেষ ঘাঁটি। সরকারী বেসরকারী ভবনে উড়তে থাকে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।

আমাদের গৌরবময় স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের খবর নতুন প্রজন্মের কাছে প্রায় অনুপস্থিত। নোয়াখালীতে যাঁরা যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এ প্রজন্মের অনেকেই তাঁদেরকে চিনেন না। আর যাঁরা জানতেন তাঁরাও ভুলতে বসেছেন। সরকারী বেসরকারী কেউ তার কোনো উদ্যোগও নেয়নি। আরো অগুনিত মুক্তিযোদ্ধদের বুকের তাজা রক্তে সিক্ত হয়ে আছে বাংলার শ্যামল প্রান্তর। সারা জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেক গণ কবর। সেগুলোর সংরক্ষণেরও কোনো উদ্যোগ নেই।
অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবার এখনো মানবেতর জীবন যাপন করছেন। নোয়াখালী শহরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা সুধারাম থানার কাছেই গ্রেনেড ছুঁড়ে হানাদারদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিলেন। যুদ্ধের মধ্যে মাথায় গুলির আঘাত লাগায় পরবর্তীতে স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে পড়েন। পথে পথে ঘুরে রোগগ্রস্ত হয়ে চিকিত্সাহীন অবস্থায় কিছুদিন পূর্বে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। সাহাব উদ্দিন এস্কেন্দার ভুলুর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে স্বাধীনতার পর পরই নোয়াখালী ষ্টেডিয়ামের নাম করণ করা হয় 'শহীদ ভুলু ষ্টেডিয়াম’। কিন্তু নতুন প্রজন্ম এবং এই ষ্টেডিয়ামে খেলতে আসা ক্রীড়াবিদ কলাকূশলী অনেকেই জানেন না স্বাধীনতা যুদ্ধে নোয়াখালীর রাজনৈতিক ও ক্রীড়াবিদ পরিবারের সদস্য ভুলুর দেশের জন্য আত্মত্যাগের গৌরবময় ইতিহাস। কাদিরপুর গ্রামের বাড়িতে তাঁর কবরটিও এখনো পাকা করা হয়নি।
শুধু মোস্তফা, শহীদ আহিদুর রহমান অদু, শহীদ সালেহ আহমেদ মজুমদার, শহীদ ভুলুই নয়, মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা জেলায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, মুক্তিযোদ্ধা আর শহীদদের সেই স্মৃতিগুলো আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে না পারলে তাঁদের ঋণ কোনোদিন শোধ করা যাবেনা।

প্রথম আলো(খোলা কলম), ৭ ডিসেম্বর, ২০০৮


মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ