স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা #### মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ

বুলেট বিদ্ধ ক্র্যাচ

গল্প

বুলেট বিদ্ধ ক্র্যাচ
মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ

এতদিন কোনো বিষন্নতা মুনিরকে স্পর্শ করতে পারেনি। আর যাই হোক সে জানে অন্ধকার মুখ লুকায় সীমাহীন জ্যোতস্নালোকে। তাই একদিন তার অন্ধকারও মুখ লুকাবে। দু ক্র্যাচের উপর দেহটা খাড়া রেখে ভাবছে মুনির। সামনে ক্যানভাসে বন্ধু মফিজের আঁকা মনিরের প্রেমিকার ছবি। বিশেষ বলে কয়ে এ ছবিটা আঁকিয়ে নিয়েছে সে। পিছনের অন্ধকার ফেলে রেখে আলোকের দিকে তাকিয়ে আছে শীলা। প্রায় বিবস্ত্র দেহ । চোখে অনেক পাওয়ার স্বাদ। যেন সমস্ত কিছু বিসর্জন দিয়ে লাভ করছে স্বর্গীয় অমৃত। মুনিরের দিকে তাকিয়ে বলতে চাইছে; ‘তুমি কি পেলে ? যুদ্ধ করে কী কী পেলে তুমি ? আমিতো পেয়েছি অনেক। বিবস্ত্রা হলাম। ধর্ষিতা হলাম । পেলাম বিরাঙ্গনা উপাধি। আর তুমি! ক্র্যাচে ভর করে অস্পৃশ্য হয়ে আছ।’
চোখটা কেমন যেন ঝাপসা হয়ে অসে। মুখ ফিরিয়ে নিলো মুনির। মাঝে মাঝে তার এমন হয়। প্রেমিকা বিরাঙ্গনা হলো। নিহত হলো। যুদ্ধ করতে গিয়ে নিজের পা-টা হারালো মুনির। তবুও একটা তৃপ্তি যেন এতদিন ছায়া হয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিলো তাকে। তার খোঁড়া শরীরটাকে যেমন করে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলো এতদিন এক জোড়া ক্র্যাচ, তেমনি ক্র্যাচ হয়ে বন্ধু মফিজ দাঁড় করিয়ে রেখেছিলো মনিরের ভাঙ্গা খোঁড়া হৃদয়টাকে। নতুবা অনেক আগেই নূয়ে পড়ে নীচে গড়িয়ে হারিয়ে যেত মনির।
যারা একদিন স্বাধীনতার বিরোধী ছিলো, তারা আজ রাতারাতি ফাও দেশ প্রেমিক সেজে মুঠি মুঠি সম্পদের মালিক হচ্ছে। বাড়ি গাড়ি প্রতাপে আজ তারা ঊর্ধে বহু ঊর্ধে।
আর মুনির! যে ভালোবাসাকে বুকে চেপে ধরে তুলে নিয়েছিলো রাইফেল। বনে জঙ্গলে ঘুরে ধর্ষিতা স্বদেশের ছবি দেখে বার বার জ্বলে উঠেছিলো। সেই ভালোবাসা আজ নিরুদ্দেশ। অথচ মুনিরতো কিছুই চায়নি। সে চেয়েছিলো শুধু তৃপ্তি। ভালোবাসার প্রতিদানে ভালোবাসা। চেয়েছিলো লাল সবুজে ছাওয়া একটা স্বদেশের ক্যানভাস। এতদিন একটা তৃপ্তি পাওয়ার ঠিকানা ছিলো তার। গত রাত থেকে সে ঠিকানাও নেই।
মফিজ ছবি আঁকতো। ছবিতে ফুটিয়ে তুলতো নির্যাতন। চিনিয়ে দিতো সমাজকে। ‘যাদের তোমরা বন্ধু ভাব তাদের পরখ করে দেখ।’ কেউকেটাদের হিংস্র মুখচ্ছবি ফুটে উঠতো তার ক্যানভাসে। এই তার অপরাধ। রাতের আঁধারে সেই মফিজের বুকে বুলেট বিঁধলো। তার রক্তাক্ত অসার দেহ ঢলে পড়লো ক্যানভাসের উপর। রক্তে রক্তে একটা ছাপ হয়ে ফুটে উঠলো দারুন অর্থবহ একটা চিত্র। বুকের রক্তে রঙ বানিয়ে যে ছবি হলো, সে ছবি কথা বললো। অসহয় ভাবে মুনির চোখ রাখলো শীলার চোখের উপর।

আজ মুনিরের কেউ নেই। কেউ নেই। যার কাছে এসে শুনতো ভালোবাসার গান। রাত্রি পোহাবে বলে ভোরের পাখির কাকলী । ক্র্যাচ সেজে যে তাকে দাঁড় করিয়ে রাখতো। মফিজ বলতো, ‘বন্ধু, স্বদেশকে তুমি যা দিয়েছো সেটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া’ সে মফিজ নেই। সে ছিলো মনিরের জন্য একটা অবলম্বন। তার এই কাঠের ক্র্যাচের মত একটা জীবন্ত ক্র্যাচ।

চারদিকে ভীষণ ভীড়। শোকাহত বিপুল জনতা। পুলিশ, সাংবাদিক। সবাই ভীড় করছে। একটা খাটের উপর সাদা চাদর দিয়ে ঢেকে রেখেছে মফিজকে।

শীলার চোখের উপর থেকে মুখ সরাল মুনির। চেয়ে দেখলো মফিজ শুয়ে আছে। আর সেই মূহুর্তে মনির যেন দেখতে পেলো। ও নিহত মফিজ নয়, একটা বুলেটবিদ্ধ রক্তাক্ত ক্র্যাচ সাদা চাদর মুড়িয়ে শুয়ে আছে।


মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ




বুড়ো আলী আজ্জমের মচমচে মুড়ি

ফিচার
বুড়ো আলী আজ্জমের মচমচে মুড়ি
মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ

বৃদ্ধ আলী আজ্জম। এই বয়সেও সারাদিন হেঁটে হেঁটে বিক্রি করেন মুড়ি । নিজের উপর অগাধ বিশ্বাস তাঁর। নিজে যা পারছেন তাই করছেন।
বয়স নব্বই ছাড়িয়ে গেছে। শরীরের চামড়াগুলো থলথলে, ভাঁজ পড়েছে অসংখ্য। পায়ে চপ্পল। পুরনো হয়ে গেছে। ক্ষয়ে ক্ষয়ে পাতলা হয়ে গেছে অনেকটা। চলতে চলতে চপ্পল মৃদু শব্দ ওঠে। গায়ে আধময়লা গেঞ্জি। এক পাশটা ছিড়েঁ ঝুলে পড়েছে অনেকটা। মাথায় বেশ বড় বড় ঢাউস বস্তা। মাইজদীর এই মফস্বল শহরে ভাঙ্গাগলি মাড়িয়ে টানা টানা স্বরে হাঁক দেন -
‘মুড়ি.ই.ই.ই.ই.... মুড়ি লাগবো...ও.ও.ও....... মুড়ি...ঈ.ঈ.ঈ......


বৃদ্ধ আলী আজ্জম। সারাদিন কারও ওপর নির্ভর না করেই শরীরটাকে টেনে নিয়ে যান সামনে।

কেউ নেই !
আছে। পোলা, মাইয়া, বৌ -ঝি আছে।
ছেলেরা দেখাশুনা করে না !
সারা শরীর থেকে ঘাম ঝড়ছিল বুড়োর। খাড়া নাক। তীক্ষ্ণ খাড়া নাকের ডগা থেকে ঘাম ঝরছিল টপ টপ করে। তীব্র উজ্জল দুটি কঠিন চোখে তাকায় বুড়ো - হাতের তালুতে ঘাম ঝাড়েন। নড়েচড়ে বসে বলেন -
ওগোরে লই ওরা আছে। হেগো খানা আমি খামু ক্যান । আমার তো এখনো গতর আছে।
কয় ছেলে আপনার ?
‘তিন ছেলে। দুই পোলা বদলা মুইয়া দেয়। বিয়া করাইছি। হেরা হেগোরে লই থাকে। ছোটটারে আইএ পর্যন্ত পড়াইছি। নোয়াখালী কলেজের তুন পরীক্ষা দিছিল। পাস কইত্তো পারেনো। এখন এই টুকটাক নারিকেলে - সুপারির ব্যবসা করে। হেটা আমার কাছে থাকে।
নোয়াখালী শহরের পাশেই রাজগঞ্জের তেতুঁইয়া গ্রামে বাড়ী আলী আজ্জমের। বাবা আইয়ুব আলী সৈয়ালের কাজ করতেন।‘৬২ সালে মারা গেছেন। বাবার রেখে যাওযা ভিটিতেই থাকেন আলী আজ্জম। একেবারে শৈশবে মাত্র নয় বছর বয়স থেকেই শুরু করেছের ব্যবসা। নানা রকমারি ব্যবসা। মাছের পোনা বিক্রি। ধান চালের ব্যবসা। তারপর শেষে ধরেছেন এই মুড়ির ব্যবসা ত্রিশ বছরেরও বেশি সময়ে ধরে এই ব্যবসা করছেন। পান- খাওয়া পাতলা ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে কালচে দাঁত নড়েচড়ে ওঠে। অসাধারন এক দৃপ্ত স্বরে বলেন -
’আমি কোনদিন কারও অধীনে ছিলাম না। স্বাধীনভাবেই চইলা আইছি। পরনির্ভর আমি না'। অসম্ভব দৃঢ়তা ফুটে ওঠে তাঁর চোয়ালে। পাকা পাতলা দাঁড়ির ফাঁকে কঠিন চোয়ালের ওপর নীল মোটা রগের রেখা ফুটে ওঠে। আপনার বৌ কি আছে এখনো ?
‘হ’ আছে । এখন আর বেশী কাজ কইত্ত পারে না। বুড়ো অই গেছে ।’
কত বছর বয়সে বিয়ে করেছেন ?
আমার তখন ষোল বছর ছিল’ ।
একটু যেন আনমনা হয়ে ওঠেন। হয়তো ঠিক এই সময়ে সুদূর অতীতের জীবনের শুরুর কোন রোমাঞ্চকর সুখকর স্মৃতি আবছা ধরা পড়ছিল। সে মুহুর্তটি বেশিক্ষণ থাকল না তাঁর।
মুড়ি কোত্থেকে কেনেন ?
‘রামগতি, চরবাটা, চরলক্ষীর চরের থুন।’
ধান কিনে ঘরে মুড়ি ভাঙ্গেন ?
‘না। বাড়ি বাড়ি যাই মুড়ি কিনি। ঘিগজ ধানের মুড়ি। এই ধানের মুড়ি বালা। খাইতে স্বাদ। মচমইচ্চা।’
মাইজদী শহর থেকে বিশ পঁচিশ কিলোমিটার দূরে গ্রামে গ্রামে ঘুরে তিনি নিজেই মুড়িগুলো দেখে শুনে কেনেন। মাইজদী বাজারে একটি ঘর ভাড়া নিয়েছেন। একশ’দশ টাকা ভাড়া দেন মাসে। মুড়িগুলো বিভিন্ন জায়গা থেকে কিনে এনে এখানে রাখেন। তারপর সেখান থেকে বস্তায় ভরে দাড়িপাল্লা নিয়ে বের হন শহরে। মন হিসাবে কিনে আনেন। বিক্রি করেন কেজি মাপে। প্রতি কেজিতে আড়াই থেকে তিন টাকা লাভ হয়। শেষবার মন কিনলেন এগারশ’ পঞ্চাশ টাকায়। বিক্রি প্রতি কেজি করলেন পয়ঁত্রিশ টাকায়।
প্রতিদিন কত কেজি বিক্রি করেন ?
‘পঁচিশ ত্রিশ কেজি।’
আপনার বৌ মুড়ি ভাজে না ! তাহলে তো আরো বেশী লাভ হতো। নিজে ভাজলে খরচ তো কম পড়তো।
পড়তো হয়তো। একটু নরম সুরে বললেন - ‘আগে ভাজতো এখন পারে না’।
একটা স্নেহার্ত সুর বেজে উঠে তাঁর কন্ঠে। শহরে ক’টি নির্দিষ্ট বাড়িতে তাঁর নিয়মিত গ্রাহক আছে। গৃহবঁধুরাই তাঁর কাছ থেকে বেশী মুড়ি কেনে।
লাভ এর চেয়ে বেশী করতে পারেন না ?
ক্ষেপা সুরেই বলে উঠলেন, ‘লাভ কইরলে তো কইত্তে পারি। ভেজাল দিলে তো লাভ হয়, কিন্তুক আল্লাহর কাছে ঠেকা থাকুম। আর হের্‌কুম কইত্তামওবা কিয়ের লাই। ইন্ডিয়ার এক কিসিম চাইল আছে। ভেজাইল্লা চাইল। দাম মেলা কম। হেগুন দি ভাইঙলে মেলা লাভ হয়। আঁর হেই লাভের দরকার নাই’।

মুড়ি বাঙালি সমাজে এক জনপ্রিয় খাদ্য। সে স্থান দখল করে নিচ্ছে নানা সুসজ্জিত মোড়কের বিস্কুট। নানান মুখরোচক প্রচারনায় আকৃষ্ট করেছে গ্রাহককে। লাভের পাহাড় গুনছে কেউ কেউ। বুড়ো আলী আজ্জম সেই লাভের পাহাড় দেখেন না। খাঁটি আর নির্ভেজাল মুড়ি গ্রাহকের হাতে তুলে দিতে পারলেই যেন তাঁর তৃপ্তি। বৃষ্টি বাদলের দিনে অথবা কোন রোদেলা দুপুরে ঘর্মাক্ত শরীরে কারো দোর গোড়ায় এই মুড়ি পৌঁছে দিতে পারলেই যেন তাঁর স্বস্তি। মফস্বল শহরে ইঁটের সুরকি ওঠা খিঁচড়ি খেউড়ে গলির রাস্তায় হেঁটে যান বৃদ্ধ আলী আজ্জম। তখন হয়তো কোন বাড়ির কোন কুলবধূ আধো ঘোমটা উচিঁয়ে দরজার ডালা মেলে মুড়ির জন্য অপেক্ষা করে। দাওয়ায় এসে বুড়ো হাঁক দেন -
‘মুড়ি লাইগবোনি মা, মুড়ি। মচমচে মুড়ি।’

মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ



আমাদের নোয়াখালী







আমাদের নোয়াখালী
মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ




গাঙ্গেয় পলিমাটি সমৃদ্ধ উপকূলীয় জেলা নোয়াখালী। এ উর্বর অঞ্চল এক সময় সমতট নামে সুপরিচিত ছিলো। সহস্র বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সাথে যোগাযোগের কারণে ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিলো এ অঞ্চল। পত্তন হয় ভুলুয়া ষ্টেটের। সে থেকে ভুলুয়া পরগণা হিসেবেই এ অঞ্চল প্রসিদ্ধি লাভ করে। ভুলুয়া বন্দরের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়। শিক্ষা দীক্ষা, জ্ঞানে মানে এলাকার মানুষ প্রভুত উন্নতি লাভ করে। মেঘনার মোহনায় সমুদ্রের উদার স্পর্শে এ এলাকার মানুষগুলো হয়ে উঠে উদার হৃদয়, আতিথি পরায়ণ আর কর্মঠ। বিক্ষুব্ধ সাগর ডিঙ্গিয়ে এদেশের মানুষ পাড়ি দিয়েছিলো দেশ বিদেশে। স্বভাবেও এ অঞ্চলের মানুষ স্বাধীন চেতা ও দৃঢ় চিত্তের আধিকারী। নানা দেশের সূফী দরবেশ আর জ্ঞানীদের আগমন ঘটেছিলো এই অঞ্চলে। কাল ক্রমে এর নাম করণ করা হয় নোয়াখালী। আরবীয় ইংরেজ আর গ্রীক সভ্যতার মিশ্রনে নোয়াখালী শহর গড়ে উঠেছিলো এক অপরুপ রুপসী সাজে। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই আবিশ্বাস্যভাবে ভাঙ্গন শুরু হয় এ জনপদের। মাইলের পর মাইল সেই ঐতহ্যবাহী জনপদ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। সেই সাথে বিলীন হয়ে যায় হাজার বছর ধরে গড়ে উঠা সমৃদ্ধশালী ঐতিহ্যের চিহ্ন। ছিন্ন ভিন্ন হয়ে পড়ে কোলাহলময় এ লোকালয়। বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায় অসংখ্য গৌরব গাঁথা অধ্যায়। ভাঙ্গাগড়ার অমোঘ বাত্যাবয়নে জেলার ভৌগোলিক ইতিহাসও বাঁক নিয়েছে নানান ভাবে। তবুও কখনো থেমে থাকেনি এর চলার গতি। এখন এই জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে চট্টগ্রাম বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। বর্তমান নোয়াখালী জেলা একসময় ফেনী, লক্ষীপুর এবং নোয়াখালী জেলা নিয়ে একটি জেলা বা বৃহত্তর অঞ্চল ছিল, যা এখনও বৃহত্তর নোয়াখালী নামে পরিচিত।
ইতিহাস
নোয়াখালী জেলার প্রাচীন নাম ছিল ভুলুয়া। নোয়াখালী সদর থানার আদি নাম সুধারাম। নোয়াখালী নামের উত্পত্তি নিয়ে নানা জনের নানান মত রয়েছে। তবে ইতিহাসবিদদের ভিতর সবচেয়ে যে মতটি প্রচলিত তা হলো. একবার ত্রিপুরা-র পাহাড় থেকে প্রবাহিত ডাকাতিয়া নদীর পানিতে ভুলুয়া-র উত্তর-পূর্বাঞ্চল ভয়াবহভাবে প্লাবিত হয় ও ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসাবে ১৬৬০ সালে একটি বিশাল খাল খনন করা হয়, যা পানির প্রবাহকে ডাকাতিয়া নদী হতে রামগঞ্জ, সোনাইমুড়ী ও চৌমুহনী হয়ে মেঘনা এবং ফেনী নদীর দিকে প্রবাহিত করে। এই বিশাল নতুন খালকে নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় "নোয়া (নতুন) খাল" বলা হত, এর ফলে "ভুলুয়া" নামটি একসময়ে পরিবর্তিত হয়ে ১৬৬৮ সালে হয়ে যায় "নোয়াখালী"।
নোয়াখালীর ইতিহাসের অন্যতম ঘটনা ১৮৩০ সালে নোয়াখালীর জনগণের জিহাদ আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ ও ১৯২০ সালের খিলাফত আন্দোলন। বৃটিশ ভারতের শেষ দিকে নোয়াখালীর রামগঞ্জে এক ভয়াবহ জাতিগত দাঙ্গা সংঘটিত হয়। সে দাঙ্গা বা রায়টের পর ১৯৪৬ সালে
মহাত্মা গান্ধী নোয়াখালীতে আগমণ করেন। এখানে তিনি জাতিগত শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য গ্রামে গ্রামে ক্যাম্প স্থাপন করেছিলেন। বর্তমান সোনাইমুড়ি উপজেলার জয়াগ নামক স্থানে গান্ধীজির নামে একটি আশ্রম রয়েছে, যা "গান্ধী আশ্রম" নামে পরিচিত।
১৭৯০ সালের পর হতে নোয়াখালী জেলা বহুবার ঘুর্ণিঝড়, বন্যা, টর্নেডো, সাইক্লোন ইত্যাদি বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে পতিত হয়।
১৯৭০ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে নোয়াখালী উপকূল লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিলো। তখন সমগ্র উপকূলে প্রায় ১০ লক্ষ লোকের প্রাণহানি ঘটে।
১৯৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামে পাক হানাদার বাহিনীর সাথে বহু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে নোয়াখালীর মাটি রঞ্জিত হয়ে আছে। সে সময়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী নিরিহ নিরস্ত্র মানুষকে বিভিন্ন ক্যাম্পে ধরে নিয়ে অকথ্য নির্যাতনের পর হত্যা করে। এছাড়াও বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক গণহত্যা চালায়। ১৯৭১ এর ১৫ই জুনে সোনাপুর আহমদীয়া স্কুল সংলগ্ন শ্রীপুরে নিরিহ গ্রামবাসীর উপর অতর্কিত এসে হামলা করে মেশিনগান চালিয়ে প্রায় শতাধিক নারী পুরুষকে হত্যা করে। এ সময় তারা শুধু মানুষ হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, সমগ্র গ্রামটিও তারা জ্বলিয়ে দিয়েছিলো। ১৯৭১ সালের ১৯ আগস্ট পাকবাহিনী বেগমগঞ্জ থানার
গোপালপুরে গণহত্যা চালায়। নিহত হন প্রায় ৫০ জন নিরস্ত্র মানুষ। ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর বীর মুক্তিযোদ্ধারা আসীম সাহসিকতায় যুদ্ধ করে নোয়াখালী জেলা শত্রু মুক্ত করে।
ভৌগলিক সীমানা
চট্টগ্রাম প্রশাসনিক বিভাগের অধীন নোয়াখালী জেলার মোট আয়তন ৩৬০১ বর্গ কিলোমিটার। নোয়াখালী জেলার উত্তরে
কুমিল্লা, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে ফেনীচট্টগ্রাম জেলা এবং পশ্চিমে লক্ষীপুরভোলা জেলা অবস্থিত। বছরব্যাপী সর্বোচ্চ তাপমাত্রার গড় ৩৪.৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রার গড় ১৪.৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস। বছরে গড় বৃষ্টিপাত ৩৩০২ মিমি। এই জেলার প্রধান নদী বামনি এবং মেঘনা
প্রশাসনিক এলাকাসমূহ

নোয়াখালী জেলায় ৯ টি উপজেলা রয়েছে। এগুলো হলো:
নোয়াখালী সদর, বেগমগঞ্জ, চাটখিল, কোম্পানীগঞ্জ, হাতিয়া, সেনবাগ, কবির হাট, সুবর্ণ চরসোনাইমুড়ি
নোয়াখালীর শহর
নোয়াখালী সদর মাইজদি ৯টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত। আদম শুমারীর সর্বশেষ তথ্য আনুযায়ী শহরের মোট জনসংখ্যা ৭৪,৫৮৫; এর মধ্যে ৫১.৫০% পুরুষ এবং ৪৮.৫০% মহিলা; জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৫৯১৫। শহুরে লোকদের মধ্যে শিক্ষিতের হার প্রায় ৬০.৭০%। নোয়াখালী সদরের আদি নাম সুধারাম। ১৯৪৮ সালে যখন
উপজেলা সদর দফতর মেঘনা গর্ভে বিলীন হয়ে যায়, তখন তা ৮ কিলোমিটার উত্তরে সরিয়ে বর্তমান মাইজদিতে স্থানান্তর করে হয়। তখন থেকে সম্পুর্ন নতুন ভাবে গড়ে উঠে নোয়াখালী শহর যা 'মাইজদী শহর' নামেও পরিচিত।
চৌমুহনী নোয়াখালীর আরেকটি ব্যস্ত শহর ও বাণিজ্য কেন্দ্র, যা একসময়ে মুদ্রণ ও প্রকাশনা ব্যবসার জন্য বিখ্যাত ছিল। সরিষার তেলের মিলের জন্যও সমগ্র দেশে এ বানিজ্য কেন্দ্রটির সুখ্যাতি ছিলো।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বসুরহাট শহরটি দ্রুত বেড়ে উঠছে এবং এটি এখন একটি ব্যস্ত শহরের রুপ নিচ্ছে । এই শহরের অধিবাসীদের একটি বড় অংশ কাজের জন্য আমেরিকা কিংবা মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী। এ অঞ্চলের যুগদিয়াতে এক সময় একটি ব্যাস্ত নৌবন্দর ছিলো যা বৃটিশ ভারতে লবণের জন্য প্রসিদ্ধ ছিলো। এখান থেকেই জাহজ বোঝাই হয়ে পাট এবং লবণ ইংল্যান্ডে রফতানী হতো। জনশ্রুতি আছে এখানে এক সময় যুদ্ধ জাহাজ তৈরী হতো এবং তা সারা বিশ্বে রফতানী হতো।
অর্থনীতি
বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা যায়, নোয়াখালী জেলার মোট আয় ৩৭৮ কোটি টাকা (১৯৯৯-২০০০)। জেলার মোট আয়ের ৪৮% আসে চাকরি বা সেবামূলক খাত থেকে। অপরদিকে আয়ের মাত্র ১৭% আসে শিল্পখাত থেকে। নোয়াখালী জেলার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রায় ৬ শতাংশ হারে হচ্ছে। নোয়াখালী জেলার মানুষের মাথা পিছু আয় ১৩,৯৩৮ টাকা (১৯৯৯-২০০০)। এ জেলার বিপুল সংখ্যক মানুষ মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকা সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে। তাদের পাঠানো বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা জাতীয় আয়কেও সমৃদ্ধ করছে।
চিত্তাকর্ষক স্থান
নোয়াখালী জেলার দক্ষিণে অবস্থিত
নিঝুম দ্বীপ দর্শনীয় স্থান হিসাবে দিন দিন খ্যাতি লাভ করছে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ভেন্যু উপযোগী শহীদ ভুলু স্টেডিয়াম, দৃষ্টি নন্দন বজরা শাহী মসজিদ, সোনাপুরে লুর্দের রাণীর গীর্জা, উপমহাদেশ খ্যাত সোনাইমুড়ির জয়াগে অবস্থিত গান্ধি আশ্রম, নোয়াখালীর উপকূলে নতুন জেগে উঠা চরে বন বিভাগের সৃজনকৃত ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, মাইজদী শহরে অবস্থিত নোয়াখালী জেলা জামে মসজিদ , নোয়াখালী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, মাইজদী বড় দীঘি, কমলা রাণীর দীঘি, হরিণারায়ণ পুর জমিদার বাড়ি প্রভৃতি দর্শনীয় স্থান হিসাবে উল্লেখযোগ্য।
উল্লেখযোগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
শিক্ষাদীক্ষায় নোয়াখালীর সুখ্যাতি বহু দিনের। সুদুর অতীতকাল থেকেই নোয়াখালী আঞ্চলের মানুষ জ্ঞান লাভের উদ্যেশে দেশ বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলো। তখন থেকেই এ আঞ্চলে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। কর্তমানেও অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষা ক্ষেত্রে সুনাম অর্জন করে চলছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য -
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় -সোনাপুর নোয়াখালী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় -মাইজদি, সোনাপুর ডিগ্রি কলেজ - সোনাপুর, অরুণ চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় - মাইজদি বাজার, হরিণারায়ন পুর উচ্চ বিদ্যালয় - হরিণারায়নপুর, নোয়াখালী সরকারি কলেজ, বিদ্যানিকেতন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় - মাইজদি বাজার, জেলার অন্যতম প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নোয়াখালী জিলা স্কুল , ব্রাদার আন্দ্রে উচ্চ বিদ্যালয় - সোনাপুর, পৌর কল্যাণ উচ্চ বিদ্যালয় - মাইজদী,এম এ রশিদ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় - মাইজদী, আহমদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়, সোনাপুর, নোয়াখালী আইন মহাবিদ্যালয় - মাইজদী, নোয়াখালী পাবলিক কলেজ - মাইজদী, চৌমুহনী মদন মোহন উচ্চ বিদ্যালয় - চৌমুহনী, বেগমগঞ্জ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় - বেগমগন্জ, গণিপুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় - গণিপুর, চৌমুহনী, চৌমুহনী সরকারি সালেহ আহমেদ কলেজ - চৌমুহনী, চৌমুহনী টেকনিক্যাল স্কুল, নোয়াখালী কৃষি ইন্সিটিউট - বেগমগঞ্জ, টেক্টাইল ইন্সটিটিউট, নোয়াখালী যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ট্যাকনিক্যাল ইন্সটিট্উট, গাবুয়া। মাইজদী ম্যাডিক্যাল এ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেইনিং স্কুল। বসুরহাট সরকারি মুজিব কলেজ- কোম্পানীগঞ্জ, বসুরহাট সরকারি এ এইচ সি উচ্চ বিদ্যালয়, বসুরহাট ইসলামিয়া সিনিয়র আলীয়া মাদ্রাসা, কোম্পানীগঞ্জ মডেল স্কুল (কেজি), বামনী আছিরিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা, , কামাল আতাতুর্ক হাই স্কুল, দাগনভূঁয়া, কবির হাট কলেজ, হাতিয়া ডিগ্রি কলেজ, হাতিয়া হাই স্কুল, প্রভৃতি।নতুন ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নোয়াখালী মেডিকেল কলজ
উল্লেখযোগ্য সংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান
জেলার অন্যতম প্রধান সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র -
নোয়াখালী জেলা শিল্পকলা একাডেমি শিশু কিশোরদের শিল্প সংস্কৃতি প্রশক্ষণ কেন্দ্র- নোয়াখালী শিশু একাডেমি, নোয়াখালী মৌমাছি কচিকাঁচার মেলা, নোয়াখালী জেলা উদীচী শিল্পি গোণ্ঠী, নোয়াখালী জেলা উদীচী কর্তৃক পরিচালিত আলতাফ মাহমুদ সংগীত বিদ্যালয়, ললিতকলা সংগীত বিদ্যালয়, মোহাম্মদ হাসেম সংগীত বিদ্যালয়। এছাড়াও প্রত্যেক উপজেলায় রয়েছে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান।
নোয়াখালী থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্র
নানান সীমাবদ্ধতার ভিতরে
নোয়াখালী সংবাদ পত্র গুলো প্রকাশিত হয়। তবে কোনো পত্রিকাই এখন পর্যন্ত নিয়মিত প্রকাশ হচ্ছেনা। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবই এর প্রধান কারণ। তবুও অনেক বাধাবিপত্তি সত্তেও কিছু পত্রিকা অনিয়মিত হলেও প্রকাশিত হয়ে আসছে। তার মধ্যে উল্লখযোগ্য, দৈনিক জাতীয় নিশান, দৈনিক জনতার অধিকার, দৈনিক জাতীয় নূর, পাক্ষিক লোকসংবাদ, নোয়াখালী কন্ঠ, নোয়াখালী মেইল, সাপ্তাহিক চলমান নোয়াখালী প্রভৃতি
অনলাইন পত্রিকা
আধুনিক বিশ্ব তথ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। নোয়াখালীও এর থেকে পিছিয়ে নেই। তথ্যপ্রযুক্তির এ প্রসারের যুগে নোয়াখালীতে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু তথ্য প্রযুক্তি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।এখান থেকে বিপুল সংখ্যক তরুণ প্রজন্ম কম্পিউটার শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর অনলাইন পত্রিকা। বেশ কিছু অনলাইন পত্রিকা অন লাইনে নিয়মিত প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে সবচেয় জনপ্রিয় ও বহুল পঠিত পত্রিকা 'নোয়াখালী ওয়েভ'। এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম অনলাইন পত্রিকা। দেশ বিদেশের বিপুল সংখ্যক পাঠক এ সাইটটি নিয়মিত ভিজিট করছেন। দিন দিন এর পাঠক সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
উন্নয়ন সংগঠন
নোয়াখালীতে বেশ কিছু বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা স্থানীয় উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখছে। তাদের মধ্যে অন্যতম,
গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট, নোয়াখালী পল্লি উন্নয়ন সংস্থা-এন.আর.ডি.এস, বন্ধন, রিমোল্ড, পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশন নেটওয়ার্ক- প্রান, সাগরিকা, দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থা, উপমা, এনরাস, ঘর, তথ্য প্রযুক্তি প্রসারে কর্মরত-দিগন্তের ডাক প্রভৃতি।
নোয়াখালীর উন্নয়নে সম্ভাবনা
খুবই ধীর গতিতে নোয়াখালীর উন্নয়নের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। এজেলায় কোনো বড় শিল্প কারখানা নেই। তবে বর্তমানে কিছু শিল্প গোষ্ঠী এ জেলায় শিল্প প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে এসেছে। এখানের উন্নয়নের সবচেয়ে বড় বাধা জেলার ভয়াবহ জলাবদ্ধতা। বছরের প্রায় অর্ধক সময় জেলার অধিকাংশ এলাকা জলমগ্ন থাকে। তাই উন্নয়নের কাজও বাধাগ্রস্ত হয়। এর জন্য নোয়াখালী খালই প্রধান দায়ি বলে অনেকে মনে করেন। এ খাল সঠিকভাবে খনন করতে পারলে যেমন জলাবদ্ধতা দূর হবে তেমন করে কৃষি উন্নয়নেও এর ভূমিকা থাকবে। তাছাড়া এ খালের পানি প্রবাহকে কাজে লাগিয়ে নৌ-যোগাযোগ ও পর্যটন শিল্পও প্রসার ঘটবে। ইতিমধ্যই জেলায় কিছু উন্নয়নের কাজ হাতে নেয়া হয়েছ। এর মধ্যে নোয়াখালী-লাকসাম সড়কটি প্রসস্ত করা হচ্ছে, নোয়াখালী মেডিকেল কলেজের কর্মসূচীও এ বছর থেকে শুরু হয়েছে। সোনাপুর থেকে চরজব্বর পর্যন্ত রেল লাইন সম্প্রসারনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। নিঝুমদ্বীপকে ঘিরে একটি ব্যাপক পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য নানান সময় বিভিন্ন মহল থেকে দাবী উঠেছে। প্রকৃতির অপার কৃপায় নোয়াখালীর দক্ষিনে সাগর থেকে জেগে উঠছে বিপুল পরিমান নতুন নতুন ভূমি। সঠিক ভাবে এ ভূমিগুলো কাজে লাগিয়ে এলাকায় ব্যাপক উন্নয়নের পরিকল্পনা গ্রহন করা যায়।

মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ

৭ ডিসেম্বর নোয়াখালী মুক্তদিবসের স্মৃতি

৭ ডিসেম্বর নোয়াখালী মুক্তদিবসের স্মৃতি
মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ

মহান মুক্তিযুদ্ধে অকুতভয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে ছিনিয়ে এনেছিলেন আমাদের গৌরবময় স্বাধীনতা। নিজের জীবন তুচ্ছ করে বাংলার শ্যামল প্রান্তরে রাজাকার আলবদর বাহিনীর সাথে একই ভাবে লড়ে গিয়েছিলেন তাঁরা। নোয়াখালীতেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। একাত্তরের ৭ ডিসেম্বর বীর মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের কাছ থেকে মুক্ত করেছিলেন নোয়াখালীর জেলা সদর। ২৬মার্চ যুদ্ধ শুরুর পূর্বেই নোয়াখালী বাসী স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলো। বস্তুত ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্সের ঐতিহাসিক ভাষনের পর পরই জেলাবাসী প্রস্তুত হতে থাকে একটি সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য। বিশেষ করে ছাত্র যুবক তরুণদের মাঝে ছিলো ব্যাপক উদ্দমতা। সে সময় শহর ও গ্রামের আনাচে কানাচে ছাত্র যুবকরা নিজেরাই নিজেদের উদ্যোগে গড়ে তুলেছিলো স্বেচ্ছাসেবক টিম। বাঁশের লাঠি দিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণও শুরু হয়ে গিয়েছিলো। যদিও সেগুলো সামরিক কোনো প্রশিক্ষণের আওতার মধ্যে পড়েনা। কিন্তু মনের মধ্যে যে বিপুল চেতনার সম্মিলন পঞ্জিভুত হয়েছিলো তার তুলনা আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবেনা।
২৬ মার্চ থেকে প্রায় এক মাস নোয়াখালী জেলা সদর হানাদার মুক্ত ছিলো। সে সময় জেলার মুক্তিযোদ্ধারা সংঘটিত হবার ব্যাপক সুযোগ পায়। সে সময় ফেনী, লক্ষীপুর আর নোয়াখালী মিলে ছিলো এটি জেলা। ফেনী ছিলো সীমান্তবর্তী অঞ্চল। জেলায় যুদ্ধের দামামা সেখানেই প্রথম শুরু হয়। নোয়াখালী শহরের প্রাণ কেন্দ্র ছিলো টাউন হল। জেলার রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক নানান ঘটনার নীরব স্বাক্ষী। সেই টাউন হলেই প্রতিষ্ঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র বা সদর দফতর। সেই সদর দফতর পরিচালনা যাঁরা করেছিলেন তাঁরা আজ সবাই প্রয়াত। তাঁদের মধ্যে ছিলেন জননেতা আব্দুল মালেক উকিল, সহিদ উদ্দিন এস্কেন্দার(কচি), আব্দুল মালেক(শ্রীপুর), মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন শহীদ সাহাব উদ্দিন এস্কেন্দার(ভুলু) প্রমুখ।
সে সময় জেলার অগুনিত তরুণ স্বত:স্ফূর্ত ভাবে এখানে এসে মুক্তিযুদ্ধে নাম লিখিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলো আনেক আনসার আর অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর লোক। তখন ফেনীতে পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ করতে ট্রাকে করে এখান থেকে মুক্তি যোদ্ধারা ছুটে গিয়েছিলো ফেনীতে। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়ার জন্য গ্রামবাসীরা যে যা পেরেছে রুটি চিড়া গুড় আর শুকনো খাবার নিয়ে ছুটে এসেছিলো নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে। সে সময় সেগুলো ছিলো এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।
যুদ্ধ শুরুর সময় নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক ছিলেন মঞ্জুরুল করিম। তিনি সে সময় মুক্তিযুদ্ধাদের সর্বত্বক সহযোগীতা করেছিলেন। এ জন্য পাকিস্তানীদের কাছ থেকে তাঁকে অনেক খেসারতও দিতে হয়েছিলো। যুদ্ধকালীন সময় তিনি নোয়াখালী থেকে বদলী হয়ে যান এবং তাঁর পরিবর্তে জেলা প্রশাসক হয়ে আসেন খানে আলম খান। জেলা মুক্ত হওয়া পর্যন্ত তিনি নোয়াখালীতেই কর্মরত ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় বৃহত্তর নোয়াখালীর মুজিব বাহিনীর প্রধান ছিলেন মাহ্‌মুদুর রহমান বেলায়েত। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ছাত্র যুবকদের সংঘটিত করে ভারতের দেরাদুনে গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং গ্রহণ করেন। আন্যদিকে সুবেদার লুৎফুর রহমানের নেতৃত্বে গড়ে উঠে সামরিক বাহিনী থেকে আসা যুব জনতা নিয়ে গঠিত মুক্তিযোদ্ধা দল। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস মুক্তিযোদ্ধারা অসীম সাহসে দখলদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। যুদ্ধে অনেকেই শহীদ হন। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ ডাকসুর সমাজ কল্যান সম্পাদক ছিলেন অহিদুর রহমান অদু। মুক্তিযুদ্ধে তিনি নোয়াখালী সদরের মুজিব বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। শত্রু মুক্ত হওয়ার মাত্র কয়দিন আগে চাপরাশির হাটে এক সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন তিনি। সাহাব উদ্দিন এস্কেন্দার ভুলু পাকিস্তানীদের হাতে বন্দী হয়ে হানাদারদের অমানুষিক নির্যাতনে শহীদ হন। চৌমুহনী কলেজের ছাত্র সালেহ আহমেদ মজুমদার এক সম্মুখ সমরে শহীদ হন। নোয়াখালী মুক্ত হওয়ার অনেক অগেই মুক্তিযোদ্ধারা ঘিরে ফেলে নোয়াখালী শহরের চতুর্দিক। শহর আক্রমনের অগে বেশ কিছু রেকি টিম অত্যন্ত গোপনে শত্রুর উপর নজরদারী করে যায়। ৬ তারিখ রাতের মধ্যেই সমস্ত প্রস্তুতি শেষ হয়। জেলা প্রশাসক খানে আলম খানকে শহর আক্রমন করার পরিকল্পনার কথা অগে ভাগেই অভিহিত করা হয়। এ সময় রাজাকার আলবদরদের ফেলে আবার ফিরে আসার মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে পাকিস্তানী বাহিনী গোপনে কুমিল্লা কেন্টনমেন্টের দিকে পলায়ন করে। হানাদারদের প্রধান ঘাঁটি ছিলো মাইজদী পিটিআই ভবন এবং সে সময়ে নির্মিতব্য সদর হাসপাতাল। এ ছাড়াও আরো কয়টি ছোট ছোট ঘাঁটি ছিলো তাদের। তার মধ্যে শহরের পূর্ব পাশে মাইজদী কোর্ট রেল ভবন ও নাহার বিল্ডিং ছিলো অন্যতম। সে ঘাঁটি গুলোর আগেই পতন হয়েছিলো।
৭ ডিসেম্বরে এলো সে মাহেন্দ্রক্ষণ। ভোরের সূর্য উঠার অনেক আগেই মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের শেষ ঘাঁটি মাইজদী পিটিআই আক্রমন করে। সে সময় সেখানে শুধু রাজাকার আলবদররাই অবস্থান করছিলো। তাদের শেষ আশা ছিলো পকিস্তানীরা এসে তাদের উদ্ধার করবে। সে ভবনটি যখন ঘিরে রাখা হয়েছিলো তখন তাদেরকে বার বার বলা হচ্ছিলো আত্মসমর্পন করার জন্য। কিন্তু তারা তা কর্ণপাত না করে উৎসুক জনতার দিকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুঁড়তে থাকে। তাদের সে গুলিতে তখন অনেক নিরিহ গ্রামবাসি নিহত ও আহত হয়েছিলেন। এক পর্যায়ে আর কোনো উপায় না দেখে রাজাকার আল বদররা একে একে আত্মসমর্পন করতে করতে ভবন থেকে বের হয়ে আসে। দুপুরের মধ্যেই পতন হয় শত্রুর শেষ ঘাঁটি। সরকারী বেসরকারী ভবনে উড়তে থাকে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।

আমাদের গৌরবময় স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের খবর নতুন প্রজন্মের কাছে প্রায় অনুপস্থিত। নোয়াখালীতে যাঁরা যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এ প্রজন্মের অনেকেই তাঁদেরকে চিনেন না। আর যাঁরা জানতেন তাঁরাও ভুলতে বসেছেন। সরকারী বেসরকারী কেউ তার কোনো উদ্যোগও নেয়নি। আরো অগুনিত মুক্তিযোদ্ধদের বুকের তাজা রক্তে সিক্ত হয়ে আছে বাংলার শ্যামল প্রান্তর। সারা জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেক গণ কবর। সেগুলোর সংরক্ষণেরও কোনো উদ্যোগ নেই।
অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবার এখনো মানবেতর জীবন যাপন করছেন। নোয়াখালী শহরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা সুধারাম থানার কাছেই গ্রেনেড ছুঁড়ে হানাদারদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিলেন। যুদ্ধের মধ্যে মাথায় গুলির আঘাত লাগায় পরবর্তীতে স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে পড়েন। পথে পথে ঘুরে রোগগ্রস্ত হয়ে চিকিত্সাহীন অবস্থায় কিছুদিন পূর্বে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। সাহাব উদ্দিন এস্কেন্দার ভুলুর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে স্বাধীনতার পর পরই নোয়াখালী ষ্টেডিয়ামের নাম করণ করা হয় 'শহীদ ভুলু ষ্টেডিয়াম’। কিন্তু নতুন প্রজন্ম এবং এই ষ্টেডিয়ামে খেলতে আসা ক্রীড়াবিদ কলাকূশলী অনেকেই জানেন না স্বাধীনতা যুদ্ধে নোয়াখালীর রাজনৈতিক ও ক্রীড়াবিদ পরিবারের সদস্য ভুলুর দেশের জন্য আত্মত্যাগের গৌরবময় ইতিহাস। কাদিরপুর গ্রামের বাড়িতে তাঁর কবরটিও এখনো পাকা করা হয়নি।
শুধু মোস্তফা, শহীদ আহিদুর রহমান অদু, শহীদ সালেহ আহমেদ মজুমদার, শহীদ ভুলুই নয়, মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা জেলায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, মুক্তিযোদ্ধা আর শহীদদের সেই স্মৃতিগুলো আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে না পারলে তাঁদের ঋণ কোনোদিন শোধ করা যাবেনা।

প্রথম আলো(খোলা কলম), ৭ ডিসেম্বর, ২০০৮


মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ

স্বামী-সন্তান ফিরে পাওয়ার অবিশ্বাস্য কহিনী

স্বামী-সন্তান ফিরে পাওয়ার অবিশ্বাস্য কহিনী
জহুরার ফিরে আসা

মাহমুদুল হক ফয়েজ

ঘুনাক্ষরেও কেউ বিশ্বাস করতে পারেনি, বেঁচে আছেন জহুরা খাতুন। লোনা জলের হিংস্র ছোবল খেয়েও অলৌকিক ভাবে বেঁচে গেছেন জহুরা। সে এক অবিশ্বাস্য কাহিনী। হতিয়া দ্বীপের নলচিরা গ্রামের মো:ইসমাইলের বৌ জহুরা খাতুন(৩৫)। ইসমাইল এটা ওটা কাজ করেন। সামান্য কিছু জমিও ছিলো। কিছু কিছু কৃষি কাজও করেন। চটপটে জহুরা গুছিয়ে রাখেন ঘর দুয়ার গেরাস্থালী। এরি মধ্যে ঘর আলো করে আসে সাহিদা, কোহিনূর আর ছেলে সাইফুল। সাগরের তীব্র স্রোতে ভাঙছে হতিয়া। ভাঙ্গনের মুখে জহুরাদের সে বসত বাড়ি। তখনো ভাঙ্গেনি হাতিয়ার নলচিরা। উত্তর দিক থেকে ভাঙ্গছিলো নদী,তবে তাতেও তারা ঘাবড়ায়নি। জন্মের পর থেকেই তারা দেখে আসছে নদী ভাঙ্গন আর ঝড় তুফান। সবকিছুই সীনা দিয়ে ঠেকিয়ে রাখে সাহসী মানুষেরা।
১৯৯১ সনের ২৯ এপ্রিল, এক মহাদুর্যোগের রাত। ফুলে ফেঁপে উঠেছে সাগর। দুর্যোগের আশঙ্কা দেখে সবাই গিয়ে উঠলো বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে সাইকোন সেন্টারে। ঘর গোছাতে গিয়ে কিছুটা পিছিয়ে পড়লেন জহুরা। একটা প্রচন্ড ঢেউ এসে কোথায় নিয়ে গেলো, জহুরার আর কিছু মনে নেই। পরদিন সকালে ঝড় যখন থামলো তখন হাতিয়ার কূলেকূলে লাশের সারি। ঘরে ঘরে কান্নার রোল। লাশ ডিঙ্গিয়ে ডিঙ্গিয়ে জহুরাকে খুঁজলেন ইসমাইল। বাবা আব্দুর রশিদের আদরের মেয়ে ছিলো জহুরা। পাগলের মত খুঁজলেন তিনিও। কোথাও পাওয়া গেলোনা তাকে। সবাই আশা ছেড়ে দিলো। মুশকিলে পড়লেন ইসমাইল। তিনটি সন্তানকে কে রাখবে! কিভাবে পালবে! আবার বিয়ে করতে বলে সবাই। কিন্তু ইসমাইলের মনের আঙ্গিনায় এক অস্বচ্ছ পর্দা এসে পড়ে বার বার। পর্দায় ভাসে চঞ্চলা চপলা একটি মুখ-জহুরা। জোর করেও সে পর্দা সরাতে পারেনি ইসমাইল। সিদ্ধান্ত নেন কোনো দিন আর বিয়ে করবেন না। ছেলেমেয়েদের দাদী-নানীর কাছে রেখে দিয়ে বদলা আর মজুরির কাজ করতে থাকেন ইসমাইল।
অন্যদিকে হাতিয়ার নলচিরা থেকে প্রায় একশ কিলোমিটার দক্ষিণে নিঝুমদ্বীপে নাটকের আরেক অঙ্কের পর্দা উঠে। ২৯ এপ্রিলের ঝড়ের রাতে সাগরের স্রোতের সঙ্গে ভেসে আসে। গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়া আর মানুষের লাশ। সাগরের পাড়ে জলকাদায় বিক্ষিপ্ত পড়েছিল সেগুলো। সে লশের মিছিলে নড়ে চড়ে উঠে একটি মানুষ। বালি আর শেওলায় জড়ানো লম্বা চুল। সূর্যের আলো পড়ে গরম হয়ে উঠে নাকের নোলক। নাক মুখ থেকে বেরিয়ে আসে বালু ভর্তি লোনা জল। চোখ মেলে তাকায় মানুষটা। এদিক ওদিক পড়ে আছে লাশ। তিনিও শক্তিহীন প্রায় অসাড়। কিছুই বুঝতে পারেন না। তবুও অসম্ভব শক্তি নিয়ে উঠে বসে। শরীরে তার একটুকরোও কাপড় নেই, আশে পাশেও কিছুনেই। লতাগুল্ম দিয়ে কোনো রকমে শরীর ঢাকেন। কিন্তু কিছুই স্মরণ করতে পারেননা। শুধু আসেপাশের লাশ দেখে লাশ দেখে বুঝতে পারেন ভয়ঙ্কর কিছু একটা হয়েছে। নিজেকেও চিনতে পারছেন না। আশ্চর্য, পূর্ব পরিচয় কিছুই তার মনে নেই। সে অবসাথায় দ্বীপের ক’জন মানুষ তাকে উদ্ধার করে। একটি কাপড় পরিয়ে তাকে নিয়ে আসে এলাকার কালাম চেয়াম্যানের কাছে। চেযারম্যান তার চিকিৎসা করান। কিন্তু আগের কিছুই আর মনে নেই তার। কোথায় ঘর কি নাম কে বাবা মা বিয়ে হয়েছিলো কিনা। কিছুইনা। কালাম চেয়ারম্যানকে বাবা বলে ডাকেন। অনেকেই তাকে বিয়ে করতে চান। কালাম চেয়ারম্যানও ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিতে চান। কিন্তু তাতে তার সায় নেই। মাঝে মাঝে আনমনা হয়ে যান, মনের গভীরে অনুভব করেন, এক অদৃশ্য সুতায় কেউ যেন টান দেয় বারে বারে। সে অনুভূতি কাউকে বুঝাতে পারেন না। সে অদৃশ্য সুতার বন্ধনের উৎসও বুঝতে পারেন না। খুঁজে পাননা। কিন্তু এমন করে তো যেতে পারে না দিন। নিঝুম দ্বীপের একদল নারী চুড়ি শাড়ি ফেরী করে বিক্রি করে। জহুরাও এই ফেরিওয়ালাদের সাথে ফেরী করা শুরু করে। চোট্ট দ্বীপ। এ বাড়ি ও বাড়ি, এঘাট থেকে ও ঘাটে। দিন কেটে যায়।
এভাবে কেটে গেছে প্রায় চার বছর। নিঝুমদ্বীপে টেষ্ট রিলিফের রাস্তায় কাজ করতে আসে হাতিয়ার ক’জন মাটিয়াল। সেই মাটিয়ালদের কয়জন ইসমাইল আর জহুরার খাতুনের পরিচিত ছিলো। তারা অবাক। একদল ফেরীওয়ালার সাথে মাথায় ঝাঁপি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে জহুরা খাতুন। কিন্তু ওদের চিনতে পারেনা জহুরা। ওরা জহুরা খাতুনকে সব স্মরণ করিয়ে দেয়। কিন্তু ওর যে কিছুই মনে নেই। ফিরে গিয়ে লোকজন স্বামী ইসমাইল ও বাবা আব্দুর রশিদকে জহুরার জহুরার বেঁচে থাকার কথা বলে। ওরা ছুটে আসে নিঝুম দ্বীপে। স্বামী আর বাবাকে দেখে আবার সব কিছু মনে পড়ে। জহুরা বুঝতে পারেন এতদিন স্মৃতিভ্রষ্ট হয়েছিল তার। এতদিনে তিনি খুঁজে পান স্বামী-সন্তান। এ সময়ের মধ্যে সাগরে ভেঙ্গে যায় ইসমাইলের ঘরবাড়ি সব। নিঃস্ব হয়ে পড়ে ইসমাইল। কালাম চেয়ারম্যান নিঝুমদ্বীপে একটি ঘর ভিটির ব্যাবস্থা করে দেন। আবার ছেলেমেয়ে আর স্বামী সংসার ফিরে পান জহুরা খতুন। এখন নিঝুমদ্বীপে স্থায়ী ভাবে বসবাস করছেনে তারা।


ইতিহাসের পম্পেই নগরী


ইতিহাসের পম্পেই নগরী
সাগরের উত্তাল করাল গ্রাসে হারিয়ে যাওয়া
নোয়াখালী পুরাতন শহর
মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ

নোয়াখালী শহরের খোঁজে
আপনি যদি খুব আগ্রহ ভরে নোয়াখালী আসতে চান তাহলে আপনাকে নামতে হবে মাইজদী কোর্টে। নোয়াখালীর বিকল্প শহর হিসাবে এটি গড়ে উঠেছে ১৯৫০ সালের দিকে। সুন্দর ছিমছাম নিরিবিলি শহর। চমত্কার পরিবেশ। শান্তির শহর হিসাবেও এর সুখ্যাতি আছে প্রচুর। না শহর না গ্রাম এমন পরিবেশে ইত:স্তত ঘুরতে ঘুরতে স্নিগ্ধতায় ভরে যাবে আপনার মন। আপনি যদি মূল নোয়াখালী খুঁজতে চান তো এখানে পাবেননা। আপনাকে যেতে হবে আরো পাঁচ ছয় কিলোমিটার দক্ষিণে। রিক্সা কিংবা বাস টেম্পুতে চড়ে নির্মল বাতাস খেতে খেতে চলে আসুন সোনাপুরে। না এখানেও নোয়াখালী খুঁজে পাবেননা। তবে সোনাপুর রেল ষ্টেশানের নাম ফলকে দেখা পাবেন ‘নোয়াখালী’ লেখা। জায়গাটি সোনাপুর, রেল ষ্টেশানের নাম নোয়াখালী। আপনি নিশ্চই বিভ্রান্তের মধ্যে পড়বেন। এখানে শেষ হয়ে গেছে রেলের সমান্তরাল লাইন। না ঠিক শেষ নয়, যেন থমকে গেছে। শুধু তো নাম ফলকই নোয়াখালী নয়। আপনি খুঁজতে থাকুন উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে চতুর্দিকে। ক’কদম সামনে রাস্তা। পূর্ব পশ্চিমে পাকা। আসলে ঠিক রাস্তা নয়। এটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়ি বাঁধ। সোনাপুর নতুন বাজার চিরে পূর্ব পশ্চিমে বিস্তৃত। দক্ষিন-পশ্চিমে রাস্তাটি ঘুরে চলে গেছে চর জব্বর, রামগতি। পূর্বে গেছে কবির হাট উপজেলায়। সোজা দক্ষিনে আর একটি রাস্তা চলে গেছে প্রায় ষাট কিলোমিটার দূরে হাতিয়া ষ্টিমার ঘাটে। কাউকে যদি আপনি জিজ্ঞেস করেন নোয়াখালী শহরের কথা। অবাক বিস্ময়ে আপনার দিকে তাকিয়ে আরো দক্ষিনে আঙুল দিয়ে দেখাবে। কিন্তু তার চেয়ে বেশী বিস্মিত হবেন আপনি নিজেই। শত বছরের কোলাহলময় কর্মচঞ্চলতায় ভরা কোথায় সে শহর! ততক্ষনে দক্ষিনের দূর সমুদ্র থেকে হয়তো আরো এক ঝাপটা লোনা বাতাস আপনাকে আরো আবিষ্ট করে ফেলবে। ইতিমধ্যে আপনি হয়তো খুব বৃদ্ধ কাউকে পেয়েও যাবেন। যিনি আপনাকে নিয়ে যাবেন সেই স্বপ্নময় এক অতীতে। সত্তর আশি বছর আগে তার শৈশব কিংবা যৌবনের সেই সব সোনালি দিনের কাছে। আপনি যদি তাঁর স্মৃতিতে আঁচড় দিয়ে বস করতে পারেন, তাহলে তাঁর স্মৃতির পঙ্খীরাজে চড়িয়ে আপনাকেও নিয়ে যাবে নিকট অতীতের এক স্বপ্নময় শহরে। যে শহর ছিলো সমুদ্র উপকূলবর্তী এক অনিন্দ্যসুন্দর প্রকৃতির প্রাচুর্যে ভরা হাজার বছরের সমৃদ্ধশালী নোয়াখালী শহর।

আমরা পৃথিবীর সমৃদ্ধশালী সভ্যতার দিকে তাকালে দেখতে পাই, সে সভ্যতা গড়ে উঠেছিলো কোনো নদী কিংবা সমুদ্রতীরে। নোয়াখালীর ভৌগোলিক অবস্থানই একটি সমৃদ্ধশালী জনপদ গড়ে উঠার জন্য যথেস্ট অনুকূলে ছিলো। হাজার বছর ধরে তিল তিল করে গড়েও উঠেছিলো। প্রাচীন কাব্যে নানা ভাবে নোয়াখালীর স্তুতি নিয়ে নানান স্লোক গাঁথা হয়েছে।

‘পূর্ব দিকে চট্টগ্রাম ত্রিপুরা পাহাড়
পশ্চিমে মেঘনা নদী ভীষম আকার
উত্তরে ত্রিপুরা জেলা দক্ষিনে সাগর
মধ্যে শোভে নোয়াখালী কিবা মনোহর’।

এই মনোহর শহর একদিনে গড়ে উঠেনি। সুদূর অতীত কালেও চির হরিতের দেশ ছিলো এই সমুদ্র-মেখলা নোয়াখালী। বিশাল সমতল প্রান্তর ছিলো এই অঞ্চল। মধ্য যুগের কবিরা সেই প্রান্তরকে তুলনা করতেন স্বর্গের মস্রিন সবুজ গালিচার মতন। প্রথিতযশা সাংবাদিক সানাউল্লা নূরী এ অঞ্চল নিয়ে গবেষনা ধর্মী লেখায় বর্ণনা করলেন, ‘আবহমান কাল থেকেই এই মাটির বুকে জুড়ে ছিলো কনকচূড় ধানের স্বর্ণালী সমারোহ। ছায়া ঢাকা পাখি ডাকা গ্রাম গুলি ছিলো তাল তমাল আর নারিকেল সুপারি কুঞ্জ খচিত একেকটি আদিগন্ত অরণ্য। সাগরের ললাটে কাঁচ-টিপের মত শোভা পেতো এই ভূ-খন্ডের ফসল সম্ভারে ভরা শ্যামল দ্বীপ মালা। সপ্তম শতকে এই উপকূলের দেশের সমৃদ্ধি বর্ণাঢ্য নৈসর্গিক সৌন্দর্য আর জনগনের সুখময় জীবনের রূপ দেখে বিস্ময় বিমূঢ় হয়েছিলেন চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন-সাঙ। সাত শ’ বছর পরে চতুর্দশ শতকে এই উপকূলীয় দেশ হয়ে দূর প্রাচ্য সফরে গিয়েছিলেন প্রখ্যাত আরব পর্যটক ইবনে বতুতা। মহান এই পরিব্রাজক আফ্রিকা মধ্যপ্রাচ্য মধ্য এশিয়া প্রাচীন ভারত দক্ষিন-পূর্ব এশিয়া এবং দূর প্রাচ্যের বহু দেশ আর জনপদ ভ্রমন করেছেন। কিন্তু বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী এই ভূখন্ডের মত আর কোনো অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সম্পদ সমারোহ তার মনে অমন গভীর ভাবে রেখাপাত করতে পারেনি’।

নোয়াখালীর আদি নাম ছিলো ‘ভুলুয়া’। নানা ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানা যায় ভুলুয়া ছিলো বঙ্গপসাগর তীরবর্তী অঞ্চলের প্রাচীনতম ইতিহাসের স্নায়ু কেন্দ্র। এটি ছিলো একসময়ের বর্ধিষ্ণু সামুদ্রিক বন্দর। কিংবন্তিতে বঙ্গোপসাগরকে ক্ষীরদ সাগর বা ক্ষীর সাগর বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। খৃষ্টের জন্মের বহু পূর্ব থেকেই ভূলুয়া বন্দর ছিলো প্রাচীন পৃথিবীর একটি আন্তর্জাতিক আত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নৌ-বানিজ্য বন্দর। এই বন্দরের সাথে সরাসরি যোগাযোগ ছিলো মিসর, লবানন, জাঞ্জিবার, বসরা, শ্রীলঙ্কা, তাম্রলিপি, সুমাত্রা, জাভা প্রভৃতি সমুদ্র বন্দরের সাথে। আসাম আরাকান সহ দূর প্রাচ্যের সাথে ছিলো এর ঘনিষ্ট যোগাযোগ।

সুপ্রাচীন কাল থেকে যোগাযোগের কারনে এ অঞ্চলে একটি স্বাতন্ত্র সভ্যতার সৃষ্টি হয়। ভাষা সংস্কৃতি কৃষ্টিতে ছিলো পৃথিবীর নানান জাতীর একটি মিশ্র সংস্কৃতি। গড়ে উঠেছিলো একটি উন্নত নগর। পরবর্তীতে যা হয়ে উঠেছিলো ঐতিহ্যবাহি ঐতিহাসিক নগরীতে। ধীরে ধীরে গড়ে উঠে পর্তুগীজ, স্পেনীয়, ইংরেজ ও আরবীয় স্থাপত্যের বহু ইমারত ও ভবন। নোয়াখালী টাউন হল ছিলো জার্মান গ্রীক ও রোম সভ্যতার মিশ্রনে অপূর্ব স্থাপত্যকলার নিদর্শন। একটি সুপরিকল্পিত নগর হিসাবে গড়ে উঠে সমগ্র শহর। ছিলো ঘোড়দৌড়ের মাঠ। ছিলো কালেক্টরেট ভবন, জর্জকোর্ট, পুলিশ লাইন, জেলখানা, হাসপাতাল, মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, স্কুল, মাদ্রাসা। ছিলো সুপ্রসস্ত রাস্তা। শহরে যান বাহনের মধ্যে ছিলো মূলত: ঘোড়ার গাড়ি। সুপ্রস্ত রাস্তার দুধারে ছিলো নয়নাভিরাম ঝাউ বীথিকা। সারা নগর জুড়ে ছিলো নানা ফল আর সুবৃহৎ বৃক্ষের সাজানো স্বর্গীয় বাগানের মত উদ্যান। না, সে অনিন্দ্য সুন্দর নগরীর সামান্যতমও আপনি এখন আর দেখতে পাবেন না। খুঁজে পাবেন না কোনো ধংসাবশেষের চিহ্ন। যা প্রত্নতাত্বিকদের মনোবাঞ্ছনা পূরণ করেত পারে। দৈব দুর্যোগে পম্পেই নগরী ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো আজ থেকে প্রায় দু’হাজার বছর আগে। সব কিছু ধ্বংস হলেও কিছুটা চিহ্ন খুঁজে পাওয়া গিয়েছিলো যার সূত্র ধরে প্রত্নতাত্বিকরা খুঁজে পেল অতীত সভ্যতার ইতিহাস। মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা, ব্যাবিলন, ক্যালাডিয়া, মেম্পিস, প্রভৃতি নগরী ইতিহাসের বিস্মৃতির অধ্যায় থেকে ফের উঁকি দেয় সেখানে কুড়িয়ে পাওয়া চিহ্ন গুলোর রেশ ধরে ধরে। বেড়ি বাঁধের উপর দাঁড়িয়ে দক্ষিনে তাকিয়ে দেখুন। আদিগন্ত সবুজের সমারোহ। ছোট ছোট খড়ের ঘর। ঘর গুলোকে ঘিরে আছে নানান ছায়া বৃক্ষ। আপনি একে একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম বলেই ভ্রম করবেন। এই এখানেই ছিলো এক সময়ের কোলাহলময় ছিমছাম নোয়াখালী শহর। এখন তার কিছুই বুঝার উপায় নেই। প্রায় হাজার বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে উঠা তিলোত্তমা এই নগরী প্রায় দু’শ বছর ধরে ভাঙ্গা গড়ার খেলা খেলেখেলে শেষ বারে যেন হঠাৎই একেবারে এক ঝাপটায় চিরতরে হারিয়ে গেলো। নোয়খালী শহর যখন ভাঙ্গনের শেষ প্রান্তে তখন চলছিলো বিশ্বযুদ্ধ। ইতিহাসের এক বিশেষ ক্রান্তিকাল। বৃটিশ সাম্রাজ্যের টিকে থাকার মরণপন লড়াই। প্রতি মুহুর্তে জাপানী বোমার আতঙ্ক। উপমহাদেশে চলছিলো বৃটিশ বিরোধী রক্তক্ষয়ী আন্দোলন। নেতাজী সুভাষ বসুর আজাদহিন্দ ফৌজের সশস্ত্র লড়াই। স্বদেশী আন্দোলন। নোয়াখালীর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। গান্ধিজীর অহিংস আন্দোলন। বাজছিলো বৃটিশ বিউগিলের শেষ করুণ নিনাদ। রাজনীতি আর প্রকৃতির ভাঙ্গাগড়ার এক অভুতপূর্ব মিশ্রন। সেই সাথে মিশেল হলো দক্ষিণ-পূর্ববাংলার সমুদ্রোপকূলীয় সাহসী লোনা মানুষদের ভিটে মাটি রক্ষার এক প্রাণপণ লড়াই। মাত্র ষাট সত্তর বছর আগে শেষ চিহ্ন টুকুও হারিয়ে গেলো। তখনও বিজ্ঞান প্রযুক্তি প্রায় সবই ছিলো। হয়তো একটু শেষ চেষ্টা করলে কিছুটা রক্ষা পেতো কিন্তু তখনকার বৃটিশ শাসকদের সীমাহীন ঔদাসিন্য আর অবহেলায় চির অভিমানি সাগর পাড়ের রূপসী জলকন্যা সাগরেই বিসর্জন দিলো নিজেকে। সে সময এলাকার মানুষরা নিজেরা নিজেদের মত করে স্বেচ্ছাশ্রমে শেষ চেস্টা করেছিলো। সাগরকে রুখতে চেয়েছিলো তারা। সাগরের মধ্যে বাঁধ দিয়ে ভাঙ্গন ঠেকাতে চেয়েছিলো। কিছুটা সফলকাম হয়েওছিলো। সেটি এখন ওবায়দুল্লা ইঞ্জিনিয়র বাঁধ নামে এলাকার মানুষের মুখে মুখে কিংবদন্তি হয়ে আছে। কিন্তু শেষ রক্ষাটি আর হয়নি।
সোনাপুর বাজারের পাশে যে বেড়ি বাঁধে আপনি দাঁড়িয়েছেন, ঠিক সেখান ১৯৭০ সনের ১২ নভেম্বরের গর্কিতে শত শত লাশ ভেসে এসেছিলো। এই সেদিনও সাগরের উত্তাল ঢেউ এসে আছাড় খেত এখানে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কালেও নিত্য জোয়ার ভাটা হতো এখানে। ধীরে ধীরে এখানে গড়ে উঠলো বাজার। সোনাপুর বাজারের মধ্যদিয়ে প্রায় চার কিলোমিটার দক্ষিণে গেলে ডানে পড়বে প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। একেবারে নতুন চরে নতুন ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এটি। তার আগে পুরাতন শহরের কিছু দেখতে চান তো বাজার থেকে একটু দক্ষিণে গেলে ডানে পড়বে মন্তিয়ার ঘোনা। শহরের গন্যমান্য ব্যক্তিদের এখানে ছিলো বাসস্থান। নতুন পাকা রাস্তা ধরে এগুলে পড়বে ইনকাম চৌধুরীর পোল। তারপর ঠ্ক্কর। জ্বী হ্যাঁ, জায়গাটির নাম ঠক্কর। নতুন বসতির নতুন মানুষেরা এই স্থানগুলোর এ রকম নাম দিয়েছে। যেমন আইন্নালাসা, আলু ওয়ালার দোকান, গুইল গুইল্লা বাজার ইত্যাদি। কি ভাবে এ রকম কিম্ভুত নাম হলো তার কাহিনীগুলোও খুব মজার।

ঘুরতে ঘুরতে আপনি প্রবীন কাউকে পেয়েও যাবেন। তিনি আপনাকে তাঁর স্মৃতি হাতড়ে আঙ্গুল দিয়ে দেখাবেন, ‘ঐ বড় মসজিদ, গীর্জা, ঐ কোর্ট বিল্ডিং, ঐতো জেলখানা, পুলিশ লাইন। আর দূরে দিগন্তে আঙ্গুল দিয়ে দেখাবেন, ‘ঐ যে ঘোড় দৌড়ের মাঠ’। আপনি বিস্ময়ে ভাবুন, কিরকম ঐতিহ্যের শহর ছিলো, যেখানে নিয়মিত ঘোড়দৌড় হোতো। তিনি আরো বলবেন, ‘এই যে এখানে ছিলো চল্লিশ ফুট প্রশস্ত সদর রাস্তা। বাস্তবে নয়, আপনি চোখ বুজে সব কলাপনায় দেখে নেবেন। ‘এই যে এখানে, সল্লাঘটিয়া, মল্লাসটাইয়ার মোড়, নাগপাড়া, বকুলতলা, দেবালয়, মন্দির’। ঘোড়দৌড়ের বিশাল চত্বরে আপনি হয়তো কান পেতে এখনো শুনতে পাবেন, উদ্দাম বেগে ছুটে চলা সেই পেশী বহুল ঘোড় সওয়ারের ছুটন্ত অশ্বখুরের শব্দ। কল্পনায় আপনি অনুভব করবেন। আর কল্পনার জগত্ ছেড়ে সত্যি সত্যি আপনি বাস্তবে দেখতে পাবেন, সেই বৃদ্ধের দুই উদাস করা চোখের কোনে চিক চিক করে সমুদ্রের লোনা জল ঝলক দিয়ে উঠছে। আর বুক চিরে উতরে উঠছে এক দীর্ঘশ্বাস, যেন বহু দূর সমুদ্রের কান্না জড়িত হুহু করে ধেয়ে আসা বিষন্ন বাতাস। চাপা কান্নায় কষ্টের বেহাগ সুরে তিনি আপনাকে শুনাবেন তাঁর হারিয়ে যাওয়া শহরের কাহিনী।

জীবন জীবিকা
সাগর পাড়ের বসতি হওয়ায় এই এলাকার মানুষের জীবিকা ছিলো মূলত: মত্স্য চাষ। নদী বন্দরের কারনে এখানে বাস করেতেন অনেক বনেদি ব্যাবসায়ী। আর উর্বর সমতল ভূমির কারনে বিপুল জনগোষ্ঠী ছিলো কৃষিজীবী। সুদূর অতীত কাল থেকে বিক্ষুব্ধ সাগর বারবার আঘাত হেনেছে এ অঞ্চলে। মানুষজনও সে সাগরকে সাহসীকতায় রুখেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। সে কারনে এ অঞ্চলের মানুষ প্রকৃতিগত ভাবেই হয়ে উঠেছে সাহসী স্বাধীনচেতা পরিশ্রমী আর একরোখা। সমতল ভূমি যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে শুরু হয়েছে বিশাল নীলজলরাসীর উদার সমুদ্র। তাই স্বভাবেও এ এলাকার মানুষ হয়েছে সমুদ্রের মত উদার প্রকৃতির। হয়েছে বন্ধুবৎসল আর অতিথিপরায়ন।

শত শত বছর ধরে এ অঞ্চলের মানুষ গিয়েছে ভিন্ন অঞ্চলে আবার ভিন্ন অঞ্চলের মানুষেরা এসেছে এ অঞ্চলে। সৃষ্টি হয়েছে এক মিশ্র স্বাতন্ত্র সংস্কৃতির। ভাষা সংস্কৃতিতে যা বাংলাদেশের অন্য অঞ্চল থেকে ভিন্ন। স্থানীয় ভাষার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে ইংরেজী জার্মান পর্তুগীজ আরাকানী আর আরবীয় ভাষার ছড়াছড়ি সহ নানান ভাষার মিশ্রন। নানা দেশের নানা জ্ঞানী গুনী শিক্ষিত মানুষের সংস্পর্শে এসে এ এলাকার মানুষের মধ্যে জেগেছে শিক্ষার স্পৃহা। এ এলাকার বিপুল জনগোষ্ঠী ছিলো বেশ শিক্ষত। শিক্ষিতের হার বেশী বলে এখনো দেশে ও বিদেশে এর সুখ্যাতি রয়েছে। এক বিরাট অংশ ছিলো বনেদি ব্যবসায়ী। ধান চাল কাপড় কাঠ লবন আর মসল্লা ছিলো মূলত: প্রধান পন্য।

বর্তমান প্রেক্ষিত
একটি মৌচাকে ঢিল ছুঁড়লে যেমন দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে সবাই ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ছুটাছুটি করে, তেমনি শহরের শেষ চিহ্ন মুছে যাবার সাথে সাথে সহায় সম্বলহীন মানুষ যে যেদিকে পেরেছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিলো চতুর্দিকে। কেউ আস্তানা গাঁড়লেন মাইজদী সোনাপুরে, কেউ ঢাকা চট্টগ্রাম সহ দেশের বিস্তীর্ন অঞ্চলে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, উপমহাদেশ জুড়ে রাজনৈতিক ভাঙ্গাগড়ার নতুন মেরুকরণ, দেশ বিভাগ সবই এক সাথে চলছিলো তখন। এক বিরাট অংশ চলে গেলো পশ্চিম বঙ্গে। সৃষ্টি হোলো বিরাট শূন্যতা।

সে শহরে ছিলো অনেক গুলো নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। রায়বাহাদুর রাজকুমার জিলা স্কুল বা আর, কে, জিলা স্কুল, বঙ্গবিদ্যালয়, আহমদীয়া হাই স্কুল, অরুণ চন্দ্র বিদ্যালয়, হরিনারায়ন হাই স্কুল, কল্যান চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়, উমা চরণ গার্লস হাই স্কুল, ব্রাদার আঁন্দ্রেজ হাইস্কুল, কেরামতিয় আলিয়া মাদ্রাসা ইত্যাদি। সেগুলো টিনের ছাউনি দিয়ে ছাপড়ার মত করে স্থানান্তরিক হোলো সোনাপুর, মাইজদীতে। সেখানে শিক্ষক নেই ছাত্র নেই। এক সময়ের উপমহাদেশ খ্যাত বিদ্যাপিট গুলো হয়ে পড়লো নীরব নিথর শূন্যতায় ভরা।

এ সময় নতুন শহর মাইজদীতে স্থানান্তরিত হোলো কোর্ট কাছারি সরকারী দপ্তর অফিস। বৃটিশ শাসনের শেষ সময়টিতে মাইজদীতে একটি বড় দীঘি কেটে তার চতুর্দিকে করা হোলা সড়ক। বাংলো প্যাটার্নের টিনের শেড করে তৈরি হোলো অফিস আদালত। মাইজদীর যে অংশে কোর্ট কাছারি বসলো তার ভিণ্ণ নাম হোলো মাইজদী কোর্ট। শহরের পশ্চিম অংশ দিয়ে চলে গেছে প্রধান সডক। আর প্রায় দেড় কিলোমিটার পূর্বদিক দিয়ে গেছে নোয়াখালী-লাকসাম রেল লাইন। শহরের উত্তর পূর্বদিকে আগেই ছিলো মাইজদী রেল ষ্টেশান তার প্রায় তিন কিলোমিটার দক্ষিনে একটি নতুন রেল ষ্টেশান স্থাপিত হোলো মাইজদী কোর্ট রেল ষ্টেশান। সে সময় শহরটি স্থানান্তরিত হওয়ার সময় হারিয়ে গেছে অনেক মূল্যবান দলিল দস্তাবেজ।

এক সময় যত দ্রুত শহর ভাঙলো তার চেয়ে যেন দ্রুত উঠতে থাকে নতুন চর। সৃষ্টি হয় আগ্রাসী চর দখলকারী গোষ্ঠির। গড়ে উঠে সেটেলম্যান্টের ভূয়া দলিল আর কাগজ তৈরির এক লোভী সুযোগসন্ধানী চক্র। এক বিপুল সরকারী ও নানা মানুষের জায়গা জমি দখল করে নেয় কুটবুদ্ধি সম্পন্ন দখলদারী গোষ্ঠী। নতুন চরে চরে হামলে পড়লো দুর্ধর্ষ লাঠিয়াল বাহিনী। চর দখল নিয়ে শুরু হোলো রক্তারক্তি হানাহানি। নতুন চরের লোনা মাটি আর মানুষের তাজা লোনা রক্ত ফিনকি দিয়ে মিশে একাকার হোলো। মৌরসী জমি ফিরে পেতে আপ্রাণ চেষ্টা করলেন অনেকে। কেউ কেউ আবার ফিরে পেতে এসেছেন তার জমি। কেউ উদ্ধার করতে পেরেছেন। কেউ পারেননি। যারা উদ্ধার করতে পারেনি আদালতের আশ্রয় নিয়েছেন তাঁরা। এখনও শত শত মামলা বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন পড়ে আছে।

নাড়ির টান
যে কোনো মানুষের স্বভাবে রয়েছে তার উতসের দিকে তার মূলের দিকে নিবিড় স্পর্শ কাতরতা। প্রকৃতিগত এক সহজাত প্রবৃত্তি। আর এই সহজাত স্বহজাত স্বভাবের জন্য হাজার হাজার মাইল দূরে তার উতসের দিকে নাড়ির টান অনুভব করে। শত বাধা বিপত্তি ডিঙিয়ে সে যেতে চায় তার উতসের গভীর মূলে। যারা এক সময় বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়েছিলো তাদের কেউ কেউ আবার ফিরে এসেছে এই এলাকায়। ধীরে ধীরে নির্মিত হচাছে রাস্তাঘাট।যোগাযোগ হয়েছে সহজ। কেউ গড়ে তুলেছেন নানা কৃষি খামার। কেউ বাড়িঘর। গড়ে উঠছে হাউজিং প্রকল্প। কেউ জমিতে করছেন চাষাবাদ।একটু একটু আবাদি হয়ে উঠেছে সমগ্র এলাকা।গড়ে উঠছে স্কুল, মক্তব, মাদ্রাসা, মসজিদ বাজার। এ এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। বিশাল এলাকা জুড়ে এর অবস্থান। পাশেই গড়ে উঠছে শিল্প এলাকা। ধীরে ধীরে আবার সৃষ্টি হবে নতুন এক সভ্যতার।

নোয়াখালী ইউনিয়ন
যে নোয়াখালী নিয়ে এত এত গবেষণা লেখালেখি। সেই নোয়াখালী নামে এখন আছে স্থানীয় সরকারের অধীনে একটি ইউনিয়ন। নদীতে ভেঙ্গে যাওয়া নোয়াখালী শহর আবার জেগে উঠলে সেটি এখন একটি ইউনিয়ন হিসাবে পরিগনিত হচ্ছে। সেই ঐতিহাসিক শহর নগরী এখন নিভৃত একটি ইউনিয়ন পরিষদ মাত্র। বৈচিত্রময় ভাষার মাহাত্ম্য ছাড়া যার আর কিছুই নেই। কিছু নেই।

মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ
ফ্রীল্যান্স সাংবাদিক
মাইজদী কোর্ট, নোয়াখালী
মুঠোফোন: ০১৭১১২২৩৩৯৯
e-mail: mhfoez@gmail.com







বুদ্ধদেব বসুর নোয়াখালী


বুদ্ধদেব বসুর নোয়াখালী
মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ



বুদ্ধেদেব বসু (জন্ম-১৯০৮ মৃত্যু-১৯৭৪)

বুদ্ধদেব বসু, বাংলা সাহিত্যের এক অসাধারন প্রতিভা। তাঁর লেখায় প্রকৃতির প্রাণের স্পর্শে মোহিত হয়েছে পাঠক। গত শতাব্দির বিশ ত্রিশ এর দশকে তাঁর শৈশব কৈশোর কেটেছে নোয়াখালীতে। শহর যখন প্রমত্ত মেঘনায় ভেঙ্গে যাচ্ছিলো তখন তাঁর স্মৃতিতে সে সব প্রথিত হয়ে গেছে স্বপ্নের মতন। পরবর্তীতে তাঁর জীবনের সমস্ত কাজে সে স্মৃতি হাতড়ে বেড়িয়েছেন। জীবনের কোনো সময় কখনো নোয়াখালীর সে স্মৃতিগুলো ভূলতে পারেননি। তাঁর স্মৃতিকথায তিনি লিখেছেন-‍

‘প্রথম চোখ ফুটলো নোয়াখালীতে। তার আগে অন্ধকার। আর তার সেই অন্ধকারে আলোর ফুলকি কয়েকটি মাত্র। সন্ধ্যা বেলায় চাঁদ উঠবার আগে উঠোন ভরে আল্পনা দিচ্ছেন বাড়ির বৃদ্ধা, মুগ্ধ হয়ে দেখছি। রাতের বিছানা দিনের বেলা পাহাড়ের ঢালুর মত করে ওল্টানো, তাতে ঠেসান দিয়ে পাতা উল্টাচ্ছি মস্ত বড় লাল মলাটের ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‘বালক’ পত্রিকার। রোদ্দুর মাখা বিকেল টেনিস খেলা। একটি সুগোল মসৃন ধবধবে বল এসে লাগলো আমার পেরাম্বলেটরের চাকায়, বলটি আমি উপহার পেয়ে গেলুম। কিন্তু সে কোন দেশ কোন বছর, আজ পর্যন্ত আমি জানিনা। আমার জীবনের ধারাবাহিকতার সঙ্গে তাদের যোগ নেই। তারা যেন কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ছবি। আনেকআগে দেখা স্বপ্নের মতো। বছরের আবর্তনেও সে স্বপ্ন ভূলতে পারিনি। সচেতন জীবন অনবিচ্ছিন্ন ভাবে আরম্ভ হলো নোয়াখালীতে। প্রথম যে জনপদের নাম আমি জানলুম তা নোয়াখালী। নোয়াখালীর পথে এবং আপথে আমার ভূগোল শিক্ষা, আর সেখানেই এই প্রাথমিক ইতিহাস চেতনার বিকাশ যে- বছর বছর আমাদের বয়স বাড়ে। আমার কাছে নোয়াখালী মানেই ছেলেবেলা আর ছেলেবেলা মানেই নোয়াখালী’।

অনিন্দ্য সুন্দর সে শহরে ছিলো বাগবাগিচা আর ফলের রকমারি বাগান। গ্রীক পর্তুগীজ আরবীয় ইংরেজ সভ্যতার ছিলো এক মিশ্র ঐতিহ্য। সে ঐতিহ্যের সঙ্গে শিশুকাল থেকেই ছিলো তাঁর সখ্যতা।

‘আগের বাড়িটি একটি বৃহৎ ফল বাগানের মধ্যে। লোকে বলতো কেরুল সাহেবের বাগিচা। জানিনা কেরুল কোন পর্তুগীজ নামের অপভ্রংশ। ফলের এত প্রাচুর্য যে, মহিলারা ডাবের জল দিয়ে পা ধুতেন। খুব সবুজ, মনে পড়ে একটু অন্ধকার, কাছেই গীর্জা। সাদা-কোট পরা জমকালো লোকদের অনাত্মীয় লাগতো। গীর্জার ভিতরে গিয়েছি, ভিতরটা ছমছমে থমথমে। বাইরে সবুজ ঘাস, লম্বা ঝাউগাছ রোদ্দুর। বনবহুল ঘন সবুজ দেশ। সমুদ্র কাছে, মেঘনার রাক্ষুসী মোহনার ভীষন আলিঙ্গনে বাঁধা। সবচেয়ে সুন্দর রাস্তাটির দুদিকে ঝাউয়ের সারি। সেখানে সারাদিন গোল গোল আলো ছায়ার ঝিকিমিকি আর ঝাউয়ের ডালে দীর্ঘশ্বাস। সারাদিন সারারাত দলে দলে নারকেল গাছ উঠছে আকাশের দিকে; ছিপছিপে সখীদের পাশে পাশে। যেখানে সেখানে পুকুর, ডোবা নালা, গাবের আঠা, মাদারের কাঁটা, সাপের ভয়। শাদা ছোট ছোট দ্রোণ ফুলে প্রজাপতির আশাতিত ভীড়- আর কখনো সে ফুল আর কি একটা গাছে ছোট গোল কাঁটা ওয়ালা গুটি ধরতো। মজার খেলা ছিলো সেগুলি পরষ্পরের কাপড়ে জামায় ছুঁড়ে মারা। কি নাম তার ভূলে গেছি। হলদে লাল ম্যাজেন্টা গায়ে সারাটা শীত রঙ্গীন। এমন বাড়ি প্রায় ছিলোনা যার আঙ্গিনায় গুচ্ছ গুচ্ছ গাঁদা ধরে না থাকতো। শ্যমল সুঠাম এক একটি বাড়ি। বেড়া দেয়া বাগান নিকোনো উঠান, চোখ জুড়ানো খড়ের চাল, মাচার উপরে সবুজ উদ্গ্রীব লাউ কুমড়োর লতায় ফোঁটা ফোঁটা শিশির’।

অপূর্ব এক নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরা ছিলো সে শহর। পথে পা বাড়ালেই ছিলো কাব্যের উপমা। প্রকৃতিতে থাকতো অপরুপ ব্যাঞ্জনা। তিনি হেঁটেছেন নোয়াখালীর পথে পথে, শহরের আনাচে কানাচে।

‘এমন কোনো পথ ছিলোনা নোয়াখালীর, যাতে হাঁটিনি। এমন মাঠ ছিলোনা যা মড়াইনি, দূরতম প্রান্ত থেকে প্রান্তে। শহর ছাড়িয়ে বনের কিনারে। নদীর এবড়ো থেবড়ো পাড়িতে, কালো কালো কাদায়, খোঁচা খোঁচা কাঁটায়, চোরাবালির বিপদে’।

সেকালে দক্ষিন বাংলার এক ব্যাস্ততম নৌবন্দর ছিলো শান্তাসীতা। সেটি এখন নতুন চর আর গ্রাম্যতার মিশেলে নবরুপে গড়ে উঠা এক পয়স্তি গ্রামীণ জনপদ। স্মৃতির কাব্যময়তায় এক রুপকথার নগরী। শুধূ কি রূপকথা ! যে বন্দরে একদিন দূর যাত্রার আগে বড় চাকার ষ্টিমার থেকে ভেঁপুর সকরুন সিম্ফনি বেজে যেতো। হাতিয়া, সন্দ্বীপ, চাঁদপুর, ঢাকা, কলকাতা বোম্বে, বার্মা আর ইউরোপীয় বন্দরের পথে পথে যাত্রা করতো যত্রীবাহী ষ্টিমার। সে সময়ের ক্ষয়িষ্ণু বন্দরের সে ঘাট থেকে তিনি অবলোকন করেছেন সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত। ডুব দিয়েছেন অপরূপ সে স্নিগ্ধ নৈ:সর্গে।

‘শান্তাসীতার নীলাভ রেখাটি যেখানে শেষ হয়েছে, দিগন্তের সে কুহক থেকে দেখা দিয়েছে আগুন রঙের সূর্য। প্রথমে কেঁপে কেঁপে তারপরে লম্বা লাফে উঠে গেছে আকাশে, দুরন্ত ঝলকে ঝলকে লাল করে দিয়ে। আবার সন্ধ্যাবেলা লাল সোনার খেলা পশ্চিমে’।

অপরূপ সে শহরকে গ্রাস করেছে রুদ্র রুক্ষ নদী। হারিয়ে গেছে কত স্মৃতি। সে রুক্ষতা প্রত্যক্ষ করে লিখলেন-

‘নোয়াখালীর সর্বস্ব ঐ নদীর কাছেই। নোয়াখালীর সর্বস্ব ঐ নদী নোয়াখালীর সর্বনাস’।

নোয়াখালীর ভাষার মধ্যে অন্যরকম এক সাতন্ত্রতা আছে, যা অন্য কোনো ভাষার মধ্যে বিরল। হাজার বছর ধরে এ জনপদের সাথে বিশ্বের নানান ভাষার সাথে যোগাযোগের সুবাদে এর ভাষাও হয়েছে অনেক সমৃদ্ধ। আঞ্চলিক ভাষার মাঝেও এত বৈচিত্র আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবেনা। এ অঞ্চলের ভাষার মাধুর্য পান্ডিত্য আর আসাধারণ ব্যায়াকরণ তাঁকে করেছিলো বিমুগ্ধ।

‘আর কোথাও শুনিনি ঐ ডাক, ঐ ভাষা, ঐ উচ্চারনের ভঙ্গি। বাংলার দক্ষিন-পূর্ব সীমান্তের ভাষা বৈশিষ্ট বিস্ময়কর। চাঁটগার যেটা খাঁটি ভাষা তাকেতো বাংলাই বলা যায়না। নোয়াখালীর ভাষা আমার মত জাত বাঙ্গালকেও কথায় কথায় চমকে দিতো। শুধু যে ক্রিয়াপদের প্রত্যয় অন্যরকম তা নয়, শুধু যে উচ্চারনের অর্ধস্ফুট ‘হ’ এর ছড়াছড়ি তাও নয়, নানা জিনিসের নামও শুনতাম আলাদা। সে সমস্ত কথায়ই মুসলমানী বলে মনে করতে পারিনা। অনেক তার মগ, কিছু হয়তো বর্মী আর পর্তুগীজের কোনো না ছিটে ফোটা। একে তো সমস্ত বাঙলাই পান্ডব বর্জিত, তার উপর বাংলার মধ্যেও অনার্যতর হোলো বাংলাদেশ। আবার সেই বাংলাদেশেও সবচেয়ে দূর, বিচ্ছিন্ন অশ্রুত এই নোয়াখালী’।

শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে সমর সেন, বুদ্ধদেব বসু, কন্যা মীনাক্ষী, প্রতিভা বসু, কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়


শহরের ঠিক সম্পূর্ণ ভাঙ্গন তিনি দেখননি। তার আগেই নোয়াখালী ছেড়ে চলে গেছেন। শহরের ভাঙ্গন যখন ঠিক মাঝামাঝি এলো তখন তিনি প্রকৃতির এক দুর্মদ রুক্ষতাকে প্রত্যক্ষ করলেন। দেখলেন শৈশবের দুরন্তপনায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাওয়া জনপদ হারানোর কষ্টছোঁয়া হৃদয় দিয়ে।

‘দেখতে দেখতে কুঁকড়ে ছোট হয়ে গেলো নোয়াখালী। আমি শেষ দেখেছি, শহরের ঠিক মাঝ খানটিতে টাউন হলের দরজায় এসে দাঁড়িয়ে- অমিতক্ষুধা জল। তারপর শুনেছি আরো ক্ষয়েছে। যে নোয়াখালী আমি দেখেছি, যাকে আমি বহন করেছি আমার মনে, আমার জীবনে, আমার স্মৃতিসত্তায়, আজ তার নাম মাত্রই হয়তো আছে, কিংবা কিছু নেই--কিছু নেই’।

সত্যি এখন সেই নোয়াখালীর কিছুই নেই। রাক্ষুসী সমুদ্রের ফেনিল ঢেউ আছড়ে পড়ে পড়ে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে গেছে বুদ্ধদেব বসুর সেই স্মৃতিময় প্রিয় নোয়াখালী। এখন আবার সেখানে জেগেছে চর। সমুদ্র চলে গেছে দূরে বহু দূরে। সেই উত্তাল সাগরের ভীষন গর্জন এখান থেকে আর শুনা যায়না। তাঁর হৃদয়ের শব্দে এখন কেউ কি শুনতে পায় সেই অপরূপ শহরের গান।

মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ
ফ্রীল্যান্স সাংবাদিক
মুঠোফোন: ০১৭১১২২৩৩৯৯

e-mail: mhfoez@gmail.com




নোয়াখালীর আধ্যাত্মিক পুরুষ, মাওলানা ইয়াকুব নূরী


নোয়াখালীর আধ্যাত্মিক পুরুষ
মাওলানা ইয়াকুব নূরী


মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ

মাওলানা ইয়াকুব নূরী ছিলেন নোয়াখালীর একজন নিভৃতচারী আধ্যাত্মিক পুরুষ। প্রায় দুই শ’ বছর পূর্বে তাঁর পিতা মাওলানা কমর উদ্দিন সুদূর ইয়েমেন থেকে ইসলামের খেদমতের উদ্দেশ্যে এ দেশে আসেন। সেই সময় পুরাতন নোয়াখালী শহরের সঙ্গে ছিলো সরাসরি সমুদ্রের যোগাযোগ। বিশ্বের নানান দেশের জাহাজ ভিড়তো সে সময়ের সমুদ্র বন্দর ‘শান্তাসিতা’ ঘাটে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, সুদূর আরব দেশ থেকে অনেক সাধক পুরুষ বহু পূর্ব থেকেই ব্যাবসা বানিজ্যের উদ্দেশ্যে এ দেশে আগমন করেন। তাঁরা শুধু ব্যাবসা বনিজ্যই করতেন না।, ইসলাম ধর্ম প্রচারও তাঁদের বড় উদ্দেশ্য ছিলো। কমরউদ্দিন তৎকালীন নোয়াখালীর এক সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবারের টুকু মুন্সির এক পর্দানশীন বিদুষী বোনকে বিয়ে করেন। মাওলানা কমরউদ্দিনও ছিলেন একজন বুজুর্গান ব্যাক্তি। কথিত আছে তাঁর ঔরসে তাঁর স্ত্রীর গর্ভে সন্তান আসার পর কমরউদ্দিন তাঁর স্ত্রীকে বল্লেন ‘তোমার গর্ভে যে সন্তান এসেছে, সে পৃথিবীতে এসে ইসলামের আলো জ্বালাবে’। এইবলে তিনি পুত্র ভূমিষ্ট হওয়ার আগেই তঁর স্ত্রীর হাতে ছেলের জন্য টুপি ও তছবিহ দিয়ে নিজের দেশে চলে যান এবং আর কখনো ফিরে আসেননি। ভূমিষ্ট হওয়ার পর ছেলের নাম রাখা হয ‘মোহাম্মদ ইয়াকুব’। বাল্যকাল থেকেই শিশু ইয়াকুবের ভিতর আধ্যাত্মিক লক্ষণ পরিলক্ষিত হতে থাকে। শৈশবে তিনি স্থানীয় মাদ্রাসায় পড়াশুনা শেষ করেন। পরবর্তীতে ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসা থেকে তিনি টাইটেল পাশ করেন। সেখান থেকে দেশে ফিরে এসে পুরাতন শহরে এক মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন। কিছুদিন পর তাঁর মায়ের আদেশে তখনকার এক বুজুর্গান মাওলানা আহম্মদ উল্লাহ্‌ সাহেবের দরবারে দোয়া নিয়ে ‘বয়ত’ হন। ইতি মধ্যে তাঁর বিভিন্ন আধ্যাত্মিকতা ও ঐশ্বরিক ক্ষমতা লোকচক্ষুর সম্মুখে প্রকাশিত হতে থাকে। দলে দলে হিন্দু মুসলমান খৃষ্টান সম্প্রদায়ের নানান মানুষ তাঁর মুরিদ হতে থাকে। একটি ঘটনা তখনকার দিনে মহা আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। তাঁর বংশধরদের কাছ থেকে জানা যায়, তখন ছিলো বৃটিশ আমল। বিভিন্ন যায়গা থেকে তাঁর মুরিদরা মানি ওয়ার্ডার করে তাঁর জন্য টাকা পাঠাতেন। সেই সময তাঁর গ্রামে তাঁরই নামের আর একজন গ্রামবাসীর কাছে ষোল টাকা মানি ওয়ার্ডার আসে। পোষ্ট অফিসের পিয়ন ভুল বসত: সেই টাকা মাওলানা ইয়াকুব নূরীর কাছে দিয়ে যায়। তিনি পোষ্টম্যান থেকে সই করে টাকা নিয়ে নেন। বেশ কিছুদিন পর প্রকৃত মালিক মাওলানা ইয়াকুব নূরীর নামে আদালতে মামলা ঠুকে দেন। সে সময় তিনি সর্বক্ষণ কাঠের খুঁটির খড়ম পরে থাকতেন। তাঁর নামে কোর্টে সমন হলে তিনি যথাবিহিত কাঠের খড়ম পায়ে কোর্টে উপস্থিত হন। তাঁর হাজার হাজার মুরিদ ও উৎসুক দর্শক সেই সময কোর্টে উপস্থিত ছিলেন। কোর্টের কঠগড়ায় পাটাতনে তিনি খড়ম পায়ে উঠে দাঁড়ালেন। বিচারকের সামনে এভাবে আসা কোর্ট অবমাননার সামিল। হাকিম এজন্য তাঁর উপর মহা রুষ্ট হন। হাকিম তাঁকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি টাকা নেয়ার কথা স্বীকার করেন কিন্তু অপরাধের কথা স্বীকার করলেন না। হাকিম জেরা করার এক পর্যায়ে পর পর তিন বার তাঁকে পাগল বলে সম্বোধন করেন। পরক্ষনেই সেই হাকিম নিজেই সম্পূর্ণ উন্মাদ হয়ে গায়ের সমস্ত পরিধান খুলে মামলার নথিপত্র সব ছিঁড়ে উলঙ্গ অবস্থায় রাস্তায় নেমে আসেন। এই ঘটনা তখন হাজার হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ করে। এ খবর দ্রুত চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে এই সাধকের প্রতি সাধারন মানুষের আরো বিশ্বাস, ভক্তি ও শ্রদ্ধা বেড়ে যায়। এ ঘটনার পর বৃটিশ সরকারের বড়লাট ও অন্যান্য উচ্চ পদস্থ কর্মচারীরা তাঁর কাছে ছুটে এসে মাপ চাইতে থাকে।

জীবিত অবস্থায় এই সাধক পুরুষ কোনোদিন এক বেলার অধিক কোনো খাদ্যবস্তু ঘরে রাখতেন না। দর্শনার্থী ও মুরিদরা যা দিতেন তার সবই তিনি গরিব দু:খীদের মাঝে অকাতরে বিলিয়ে দিতেন। তাঁর আধ্যাত্মিক ও ঐশ্বরিক ক্ষমতার জন্য তাঁকে সবাই ‘নূরী’ বা ‘ঐশ্বরিক আলো’ বলে সম্বোধন করতেন। এখনো আনেক মানুষের মুখে মুখে এই সাধক পুরুষের ঐশ্বরিক নানান ক্ষমতার কথা প্রচারিত হয়ে আসছে। নোযাখালীর সদরের সোনাপুরে তাঁর নামে ‘নূরীয়া মাদ্রাসা’ ও ‘নূরীয়া প্রাইমারি স্কুল’ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতি বছর দশ ফাল্গুন যথাবিহিত তাঁর ঔরশ মোবারক পালিত হয়। দেশ বিদেশের নানান ধর্মের মানুষ সে ঔরশে সামিল হন।

মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ
ফ্রীল্যন্স সাংবাদিক
মাইজদি কোর্ট, নোয়াখালী
মুঠোফোন: ০১৭১১২২৩৩৯৯
e-mail: mhfoez@gmail.com

নোয়াখালী জামে মসজিদ, ধর্মপ্রাণ মানুষের তীর্থস্থান


নোয়াখালী জামে মসজিদ, ধর্মপ্রাণ মানুষের তীর্থস্থান
মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ

নোয়াখালী শহরের প্রাণ কেন্দ্রে এক অপূর্ব স্বর্গীয় ভাবাবেগ নিয়ে অবস্থান করছে মাইজদী জামে মসজিদ। মাইজদী বড় মসজিদ নামেও এর পরিচিতি রয়েছে। প্রতিদিন শতশত ধর্মপ্রাণ মুসল্লী নিয়মিত এই মসজিদে নামাজ আদায় করেন। পুরাতন নোয়াখালী শহর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবার পরে মাইজদীতে নতুন শহর গড়ার সময়য়েই ১৯৫০ সালে মসজিদটির নির্মান কাজ শুরু হয়। দিনে দিনে নানা প্রতিষ্ঠান ও নানান জনের অনুদান আর নোয়াখালী বাসীর প্রতিদিনের মানতের টাকায় গড়ে উঠছে অনন্য সুন্দর এই মসজিদ। এর পশ্চিমে রয়েছে একটি বড় পুকুর, দক্ষিনে জিলা স্কুল উত্তরে ষ্টেশান রোড এবং জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল ও জেলা সড়ক বিভাগের ভবন, পূর্বে গণপূর্ত বিভাগের ভূমি। এই মসজিদের সীমানা ৩ একর ৮০ ডিসিমেল। এই মসজিদটি তৈরির সময় ছোট এক তলা ভবনে অপরুপ মুসলিম ও দেশী লোকজ শিল্প সৌন্দর্যে লতাপাতা আর নানা কোরআনের আয়াত ও উপদেশ বাণী উৎকীর্ণ করে নির্মান করা হয়। মসজিদের দৈর্ঘ্য ১৩০ ফুট ও প্রস্থে ৮০ ফুট আয়তনে মূল ভবনে তিনটি সুর্দৃশ্য গম্বুজ ও নয়টি সুউচ্চ মিনার ইসলামী স্থাপত্যে নির্মিত হয়। পুরাতন শহর জামে মসজিদটি ছিলো সকল ধর্মের সকল মানুষের শ্রদ্ধাবনত উপাসনার পীঠস্থান। মূল নোয়াখালী শহর মেঘনা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবার সময় সেই মসজিদটিও নদীগর্ভে চিরতরে হারিয়ে যায়।

অনেক কিংবদন্তি ছিলো সে মসজিদকে ঘিরে। জনমনে বিশ্বাস ছিলো কেউ কোনো কিছু মানত করলে মহান আল্লাহতালা সে মানত কবুল করতেন। অনেক প্রবীনজনদের কাছে জানা যায়, বহু পুরাতন সে মসজিদের ভিতর কথা বল্লে এক প্রকার ঐশ্বরিক গুমগুম আওয়াজ করতো। গভীর রাতে সমস্ত পৃথিবী যখন নি:শব্দ হয়ে আসতো তখন কেউ কোরআন তেলওয়াত করলে কোরআনের সে বাণী অলৌকিক ভাবে মসজিদের দেয়াল থেকে গুরু গম্ভীর আওয়াজে আবার ফিরে আসতো। সে মসজিদটি যখন নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছিলো তখন প্রতিদিন দলে দলে মানুষ ছুটে গিয়েছিলো ভাঙন দেখতে। অনেকের বিশ্বাস ছিলো অলৌকিক কারনে উত্তাল সাগর থেকে হয়তো মসজিদটি রক্ষা পাবে। কিন্তু হাজার হাজার নারী পুরুষের বুকফাটা ক্রন্দন ছাপিয়ে অমিত ক্ষুধার্ত সাগরের উন্মত্ত ঠেউয়ের তোড়ে টুকরো টুকরো হয়ে মসজিদটি সাগরে বিলীন হতে লাগলো। তখন মানুষ প্রত্যক্ষ করলো যে, অসংখ্য মাটির ফাঁপা পিপা দিয়ে গাঁথা হয়েছিলো মসজিদের ভীত। সম্ভবত: এ শুণ্য মাটির পিপের ভীতের জন্যই শব্দ বিজ্ঞানের স্বাভাবিক নিয়মে মসজিদে কথা বল্লে প্রতিধ্বনিত হয়ে গুমগুম আওয়াজ করতো। সে মসজিদটি বিশাল ঠেউয়ের সাথে সাথে একএক বার একএক টুকরো হয়ে নদীতে বিলীন হয় গেলো। তবু বিশ্বাসে বদ্ধমূল মানুষজন ভাবলো পুরো মসজিদটি হয়তো অন্য কোথাও আবার পুরোপুরি ভেসে উঠবে। সাগর পাড়ে নদীর চরায় দূরে মসজিদটি আবার ভেসে উঠেছে এই গুজব কোথাও উঠলে মূহূর্তের মধ্যে হাজার হাজার মানুষ উর্দ্ধশ্বাসে ছুটতো সেদিকে। কিন্তু সকল জল্পনা কল্পনার অবসানঘটিয়ে মসজাদিটি সত্যি সত্যিই নদীগর্ভে চিরতরে হারিয়ে গেলো। পাঁজর ভাঙা মানুষের সেই বেদনা আর স্মৃতি ধরে রাখার জন্য নতুন শহরে মানুষের নিজস্ব প্রচেষ্টায় ফের তিল তিল করে গড়ে উঠে এ মসজিদ। মসজিদের প্রবেশ পথে অনন্য সুন্দর গোলাপ বাগান যে কোনো ধর্মপ্রাণ রুচিশীল মানুষের হৃদয় পবিত্র স্নিগ্ধতায় ভরে দেয়। মসজিদের ভিতর উত্তর পূর্ব কোনে কালো পর্দায় ঘেরা দিয়ে মহিলাদের নামাজ পড়ার বিশেষ ব্যবস্থা আছে। প্রতিদিন অসংখ্য পর্দানশিন মহিলা সেখানে নামাজ আদায় করেন। এখানে আরো আসে হিন্দু খৃষ্টান সহ সকল ধর্মের সকল নারী পুরুষ, শ্রদ্ধাবনত চিত্তে ভক্তি জানান তাঁরা। মানত করে দিয়ে যান খুশিমত উপঢৌকন। সকল ধর্মের সকল মানুষের এটি যেন এক মহামিলনের তীর্থস্থান। একটি মসজিদ কমিটির পরিচালনা বোর্ডের মাধ্যমে এর কার্যক্রম পরিচালিত হয়। মসজিদের সাথে আছে একটি এতিম খানা ও মাদ্রাসা। পাশেই আছে মসজিদের কবরস্থান। এখানে শায়িত আছেন প্রাক্তন সেক্রেটারী আনোয়ার উল্লাহ পেষ্কার, লেংটা হুজুর, নোয়াখালী পৌর সভার সাবেক চেয়ারম্যন মরহুম শহীদ উদ্দিন এস্কেন্দার (কচি) ও জেলার গন্যমান্য ব্যক্তিরা। এ মসজিদের অভ্যন্তরে আছে সুদৃশ্য ঝাড়বাতি। পুরানো মসজিদ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবার সময় ঝাড়বাতি, লোহার সুদৃশ্য গেইট ও অসংখ্য শ্বেত পথরের টুকরো রক্ষা করা গেছে। সেগুলো এখন বর্তমান মসজিদের শোভা বর্ধন করছে। মুসল্লিদের সার্বিক সুবিধার জন্য এখানে সম্প্রতি নির্মিত হয়েছে আধুনিক শৌচাগার, গোসলখানা ও ওজু খানা।

মসজিদের সাথে ‌‌‌‍‌‌‌‌ মানব কল্যান মজলিস নামে একটি জনহিতকর সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে। যা আর্তমানবতার সেবায় মসজিদ ভিত্তিক একটি সংগঠনের রুপ নিয়েছে। সুপার মার্কেট, রেষ্ট হাউস্, পুকুর লিজের অর্থ, সমাজের দানশীল মহত ব্যক্তি আর অসংখ্য ধর্মপ্রাণ মানুষের অনুদানে দিন দিন শ্রীবৃদ্ধি পাচ্ছে এই মসজিদ। ১৮৪১ সালের পুরাতন নোয়াখালী শহরে মরহুম ইমাম উদ্দিন সওদাগর নিজের জমিতে যে জামে মসজিদটি স্থাপন করেছিলেন দিনে দিনে নানান জনের নানান স্পর্শে তার সুখ্যাতি চতুর্দিকে বিকশিত হয়ে উঠেছিলো। কালক্রমে ভাঙাগড়া নোয়াখালীর পলিমাটিতে মসজিদটি দিন দিন আবার ঐশ্বরিক ঐশ্বর্যে শুশোভিত হয়ে উঠছে।

মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ
ফ্রীল্যান্স সাংবাদিক
মুঠোফোন: ০১৭১১২২৩৩৯৯
e-mail: mhfoez@ gmail.com

রূপে ঝলমল নিঝুম দ্বীপ


রূপে ঝলমল নিঝুম দ্বীপ
মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ

নোয়াখালী উপকূলে গভীর সমুদ্রে জেগে উঠা এক রহস্যময়ী দ্বীপ 'নিঝুমদ্বীপ'। সাগরের উত্তাল ফেনিল তরঙ্গ, নীল আকাশ আর ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘেরা সেখানে নিত্য মাতামাতি করে। নীরবে নিভৃতে সাগরের গর্ভ থেকে ধীরে ধীরে এ দ্বীপটি জেগে উঠেছে। এখন সে পূর্ণ যৌবন প্রাপ্ত সবুজ অরণ্যের নেকাবে ঘেরা লাস্যময়ী সাগর দূহিতা। তার শান্ত স্নিগ্ধ রূপ ছড়িয়ে পড়ছে চতুর্দিকে। দেশ বিদেশের মানুষ কৌতুহলী হয়ে উঠছে এ দ্বীপকে ঘিরে।


নিঝুম দ্বীপের জন্ম
নোয়াখালী দক্ষিণে সাগর বেষ্টিত হাতিয়া দ্বীপ। তারও দক্ষিণে অথই নীল সমুদ্র। শত শত বছর ধরে হাতিয়া দ্বীপ এক সমৃদ্ধশালী জনপদে পরিনত হয়। এখানের অনেকেই বংশ পরম্পরায় অবস্থাপন্ন কৃষক ও মত্স্যজীবি। অনেকে ছিলেন বনেদী ব্যাবসায়ী। উত্তাল সাগরের সাথে হেসে খেলে এদের বেড়ে উঠা। সাম্পান আর বড় বড় বজরা নিয়ে এরা যুগ যুগ ধরে সাগরে মাছ ধরতে যেতেন। পঞ্চাশের দশকের দিকে হাতিয়ার জেলেরা দক্ষিণে দূর সমুদ্রে দেখতে পেলেন সাগরের মধ্যখানে একটি বিশাল ভূখন্ড জেগে উঠছে। তাদের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তারা দেখে আসছেন সমুদ্রের এসব অঞ্চলে মাঝে মাঝে এরকম ভাসমান দ্বীপ ভেসে উঠে আবার তীব্র স্রোতে হারিয়েও যায়। তারা ভেবেছিলেন এরকমই হয়তো কোন দ্বীপ এটি। কিন্তু দেখা গেলো ধীরে ধীরে সে ভূখন্ড চিক চিক করে আরো বেশী দৃশ্যমান হচ্ছে দিন দিন। এক সময় সত্যিই সেটি একটি রুপময় দ্বীপে রুপ নিলো। এ দ্বীপের একটি বৈশিষ্ট্য হলো, এ দ্বীপের মাটি চিকচিকে বালুকাময়। জেলেরা নাম দিলেন 'বাল্লারচর' বা বালুর চর। জেলেরা দূর সমুদ্রে যাবার পথে একটি বিশ্রাম আর আশ্রয়ের জায়গাও খুঁজে পেলেন। শুকনো মৌসুমে তাঁরা সে বালুর মধ্যে মাছ শুকানোর কাজও শুরু করলেন। ধীরে ধীরে সে চরে নল খগড়া উরি আর বুনো ঘাস জমাতে লাগলো। হাতিয়ার মহিষের বাথানিয়ারাও যাওয়া আসা শুরু করলেন সে দ্বীপে। ওসমান মিয়া নামে এক বাথানিয়াও তরঙ্গ বিক্ষুদ্ধ সাগর ডিঙ্গিয়ে তার বাথানের শত শত মহিষগুলো নিয়ে গেলেন সে দ্বীপে। তার নামেই সে দ্বীপের নাম হয় চর ওসমান। সরকারী দলিল দস্তাবেজে চর ওসমান হিসাবে এটি এখন লিপিবদ্ধ আছে। ধীরে ধীরে দ্বীপাটির আয়তন বাড়তে থাকে। কিছু কিছু গাছ গাছালী জন্ম নিলো। ফুটে উঠলো তার শান্ত স্নিগ্ধ রূপ। দ্বীপের পরিবেশ হলো নীরব নিঝুম তার চতুর্দিকে ফেনীল সাগরের ছন্দময় খেলা।
নিঝুম দ্বীপের নাম করণঃ
সত্তর দশকে হাতিয়ার সংসদ সদস্য ছিলেন আমিরুল ইসলাম কালাম। তিনি দেশী-বিদেশী পর্যটকদের নিয়ে গেলেন সে দ্বীপে। অবাক বিষ্ময়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে সবাই অবলোকন করলেন এর শান্ত স্নিগ্ধ রূপ। তিনি এ দ্বীপের নাম দিলেন ’নিঝুম দ্বীপ। সে থেকে নিঝুম দ্বীপ হিসেবেই এর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। কিছু জেলে আর বাথানিয়া সেখানে অস্থায়ীভাবে আবাস গড়ে তুলেছিলেন। ৭০ এর ১২ নভেম্বর প্রলয়কারী ঘূর্ণিতে সব নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। বিরান হয়ে যায় সে জনপদ। স্বাধীনতা পর বন বিভাগ এর দায়িত্ব নেয়। শুরু করে বনায়ন।
এক সময়ের নিঝুম নীরব নিথর জনপদ মানুষের পদচারনায় এখন ধীরে মুখরিত হয়ে উঠছে। গড়ে উঠছে জনবসতি। গাবাদি পশুর খামার। দ্বীপ সংলগ্ন চতুর্দিকে বিপুল মৎস্য ভান্ডার আর দুলর্ভ খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ নিঝুম দ্বীপ সম্ভাবনার এর উজ্জল দিগন্ত উম্মোচিত করছে।

জনবসতিঃ
১৭৯৪ সনের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বুরো কর্তৃক প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী তখন এর জনসংখ্যা ছিলো ৪৫জন। পুরুষ ২৩ জন ও মহিলা ২২জন। স্বার ছিলো ৭জন। এরা সবাই বিভিন্ন যায়গা থেকে এখানে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন। ভোলা, মনপুরা, রামগতি থেকেও অনেকে এখানে চলে আসেন। ১৯৮৮ সনে সরকারি ভাবে ৯টি গুচ্ছগ্রাম সৃষ্টিকরে ৫শ ৪৬টি পরিবারকে বসতির ব্যাবস্থা করা হয়। এই গুচ্ছগ্রাম গুলো হলো, বসুন্ধরা, বাতায়ন, আনন্দ, আগমনি, ছায়াবীথি, ধানসিঁড়ি, যুগান্তর, সূর্যদয় ও পূর্বাচল। এখানে প্রতিটি পরিবারকে দেয়া হয় দুই একর করে জমি। যাতে রয়েছে, বাড়ী ৮ ডিসিমেল ও কৃষি জমি ১ একর ৯২ ডিসিমেল করে। একটি বড় দীঘির চতুর্দিকে বাড়ী গুলো করা হয়েছে। এছাড়াও এ দ্বীপে বর্তমানে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার অধিবাসী বসবাস করছে। দিন দিন এ সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে।

জীবিকাঃ
এ অঞ্চলে মানুষদের প্রধান জীবিকা সমুদ্রে মৎস্য আহরণ ও কৃষি। নিঝুম দ্বীপে একটি ছোট্ট পরিসরের বাজার রয়েছে। এ দ্বীপে আগে কখনো কোন পোষ্ট অফিস ছিলো না, অতিস¤প্রতি বাজারের মধ্যে একটি পোষ্ট অফিস চালু হয়েছে। তবে এখনও ব্যবসা বাণিজ্য বা যোগাযোগের জন্য এখানে অধিবাসীদের অসুবিধা রয়ে গেছে। এ দ্বীপে শুটকীর ব্যবসার সঙ্গে অনেকেই জড়িত। শুকনো মৌসুমে এখানে শত শত মন মাছ শুটকী করা হয়। এখানে রয়েছে অনেক গুলো মাহিষের বাথান। পর্যাপ্ত দুধ পাওয়া যায় সেখান থেকে। সে দুধ থেকে তৈরী হয় উৎকৃষ্ট মানের দই। চট্টগ্রাম মাইজদীতে মহিষের দই-এর বিপুল চাহিদা রয়েছে।

শিক্ষা:
নিঝুম দ্বীপে দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। একটি নিঝুম দ্বীপ বিদ্যানিকেতন অপরটি নিঝুম দ্বীপ শতফুল স্কুল। স্কুল দুটি দুই সাইক্লোন সেন্টারে গড়ে উঠেছে। প্রায় ১ হাজার ২শ ছাত্র-ছাত্রী এখানে পড়া শুনা করে। হাতিয়া দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থা নামে একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান এ এলাকার জনগণের জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ নানান উন্নয়ন কর্মের সহযোগীতা করে আসছে। এদের মধ্যে আক্ষরিক শিক্ষা না থাকলেও সামাজিক শিক্ষায় অত্যন্ত নিষ্ঠাবান। দ্বীপের জনগণ বেশ ভদ্র বন্ধুবৎসল ও কর্মঠ।

নিঝুম দ্বীপের আয়তন:
নিঝুম দ্বীপের বর্তমান আয়তন প্রায় ৪৪ বর্গ কিলোমিটার এর উত্তর অংশে রয়েছে বন্দরটিলা। বনের মাঝা-মাঝি একটি সরু ছরা বা খাল দ্বীপকে দুভাগ করছে। এর উত্তর অংশ বন্দরটিলা ও হাতিয়া দক্ষাণ অংশ মোক্তারিয়ার সঙ্গে দুরত্ব কমে আসছে। এখানে মাঝখান বরাবর সাগরের গভীরতাও কমে আসছে। এর উপর দিয়ে একটি বাঁধ কিংবা সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা চলছে। তাহলে হাতিয়া থেকে সরাসরি সড়ক পথে নিঝুম দ্বীপ যাওয়া যাবে। দ্বীপের পূর্ব ও দক্ষিণে সাগর থেকে জেগে উঠছে আরো নতুন নতুন ভুখন্ড। এত দিন নিঝুম দ্বীপটি ছিলো হাতিয়ার জাহাজমারা ইউনিয়নের একটি ওয়ার্ড। বর্তমানে নিঝুম দ্বীপকে ইউনিয়নে উন্নিত করা হয়েছে। । বন বিভাগের সঙ্গে স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে মনোমালিন্য ছাড়া আইন শৃঙ্খলার পরিস্থিতি অত্যন্ত শান্ত। এ দ্বীপের দক্ষিণ পশ্চিম কোনে ইতিমধ্যে একটি বড় দ্বীপ জেগে উঠেছে। ঢাল চর হিসাবে এটি এখন চিহ্নিত হয়েছে। দ্বীপের আশ-পাশে ছোট বড় কয়টি দ্বীপ রয়েছে সেগুলোর মধ্যে চর কালাম, রৌশনীচর, দমারচর প্রভৃতি অন্যতম। বিশেষজ্ঞদের ধারনা নদী বাহিত পলি মাটি জমে জমে বেড়ে যাচ্ছে নিঝুম দ্বীপের আয়নত।

অভ্যন্তরিন যোগাযোগঃ
এ দ্বীপের অভ্যন্তরিন যোগাযোগ এখানো তেমন উন্নত নয়। এখানে কয়টি মাটির রাস্তা রয়েছে। সমগ্র দ্বীপে কোন যাত্রীবাহি যানবাহন নেই। কোন রিক্সাও নেই। এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যেতে হেঁটেই যেতে হয়। স¤প্রতি এখানে একটি পোষ্টঅফিস স্থাপিত হয়েছে। রেড ক্রিসেন্টের ওয়ারলেসের মাধ্যমে জরুরী সংবাদ আদান প্রদান হতো। দূর্যোগের সময় এই ওয়ারলেস সেইটিই ছিলো একমাত্র আবলম্বন। স¤প্রতি গ্রামীণ ফোনের টাওয়ার বসানো হয়েছে। এখন মোবাইলেও যোগাযোগ করা যায।

অর্থনীতিঃ
নিঝুম দ্বীপে প্রচুর পরিমাণ বিভিন্ন খনিজ পদার্থ রয়েছে বলে ইতিমধ্যে বিভিন্ন সংস্থার জরিপে ও বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন। এখানে রয়েছে মহিষের বড় বড় বাথান। সবগুলোই স্থানীয় বাথানিয়াদের নিজস্ব উদ্যোগে গড়া। এখান থেকে উৎপন্ন দুধ থেকে তৈরী হয় বিখ্যাত দই। অথচ প্রক্রিয়াজাত করার কোন ব্যবস্থা নেই সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেলে দুগ্ধ খাতে বিপুল অর্থনৈতিক সুফল পাওয়া যাবে। এ ছাড়াও নিঝুম দ্বীপ সংলগ্ন চর কমলা, চর রোশনী, চর রোহানীরা, চর নুরুল ইসলাম, চর পিয়া, ঢালচর, মৌলভী চর, চর গিয়াস উদ্দিন, তেলিয়ার চর, চর রশিদ, চর আজমন, চর আমানত, সাগরদী প্রভৃতি দ্বীপে চারণ ক্ষেত্র করা যেতে যারে। নিঝুম দ্বীপ ঘিরে রয়েছে বিপুল মৎস্য ভান্ডার। এখানে রয়েছে প্রাকৃতিক চিংড়ি জোন। সুস্বাধু ইলিশের চারণ ক্ষেত্র এই জলসীমানা। সুন্দর সুষ্ঠু প্রকৃতি নির্ভর পরিকল্পনা নিলে দেশের অর্থনীতির বিপুল উন্নতি সাধিত হবে বলে অনেকেই মত প্রকাশ করেছেন।
বনায়ন
নিঝুম দ্বীপের অন্যতম আকর্ষনীয় দিক হলো এর বিশাল শান্ত স্নিগ্ধ গভীর ঘন বন। নিঝুম দ্বীপের আয়তন ৪৪ বর্গকিলোমিটারের প্রায় তিন চতুর্থাংশই গভীর ঘন বনে আবৃত। স্বাধীনতার পর থেকে বন বিভাগ এখানে বন সৃজন করে আসছে। তবে গভীর সমুদ্রের আবহাওয়ার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নতুন মাটিতে বাইন ও কেওড়া গাছ লাগানো হয়েছে। নতুন মাটিতে নতুন চরে এ গাছগুলো বেশ কার্যকর। আবার নতুন মাটি পোক্ত ও শক্ত করার জন্য এ গাছ গুলো বেশ উপযোগী বলে বন বিভাগ জানিয়েছে। এ বনের মধ্যে আছে বানর, উদবিড়াল, গুঁই সাপ, নানান জাতের পাখি, বন মোরগ, কাঠরিড়ালী, বিভিন্ন ধরনের সাপ, কাছিম, প্রভৃতি। আর আছে হাজার হাজার মায়াবি হরিণ। লাখ লাখ অতিথি পাখির জন্য এ দ্বীপ এক বিরাট আকর্ষন। প্রচন্ড শীতে খাদ্যের অন্বেষণে এসব পাখিরা উড়ে আসে এ দ্বীপে। এ সময় পাখিদের অপূর্ব মোহনীয় কূজন শুনে মনে হয় কোন এক রূপকথার পঙ্খীরাজ্য। তবে শিকারীদের জন্য দুঃসংবাদ হলো এ রাজ্যে শিকার নিষিদ্ধ। এ দ্বীপের ভিতর আছে মানুষে প্রাণীতে এক নিবিড় সংখ্যতা। ঘন বনের মধ্যে উৎপন্ন হয় উৎকৃষ্ট মধু। প্রতি বছর আহরিত হয় শত শত লিটার মধু।

আকর্ষনীয় পর্যটন কেন্দ্রঃ
একটি আকর্ষণীয় লাভজনক পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে নিঝুম দ্বীপ এক স্বর্গভূমিতে পরিনত হতে পারে। দ্বীপের দক্ষিণ বৃত্তাকার প্রায় ১২ কিলোমিটার জুড়ে রয়েছে সী-বীচ। চিকচিকে মোটা বালুকারময় এ সৈকত ঢালু হয়ে চলে গেছে সমুদ্রের অভ্যন্তরে। ভাটায় জেগে উঠে দীর্ঘ বেলাভূমি। সে বেলাভূমিতে সাগরের ফেনীল উর্মীমালা আছড়ে পড়ার অপূর্ব দৃশ্য কাউকে আলোড়িত না করে পারে না। চন্দ্রালোকে জোয়ার ভাটায় এর মনোমুগ্ধকর দৃশ্য এক স্বর্গীয় অনুভূতি সৃষ্টি করে। জোৎস্নার আলোয় ফেনিল উর্মীমালার শীর্ষে শীর্ষে যেন এক একটি মনি মুক্তা জ্বল জ্বল করে জ্বলতে থাকে। দ্বীপের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত অবলোকন করা যায়।

নিঝুম দ্বীপকে একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানিয়েছিলো। ১৯৭৪ সনে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন এ দ্বীপকে একটি পূর্ণাঙ্গ পর্যটন কেদ্র করার পদপে নিয়েছিলো। বর্তমানে এ দ্বীপকে পর্যটন দ্বীপ হিসাবে গড়ে তোলার জন্য সরকারী ব্যাপক পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। বর্তমানে সেখানে কয়টি সরকারি বেসরকারি রেষ্ট হাউজ করা হয়েছে। একটি বেসরকারি পর্যটন প্রতিষ্ঠান সেখানে পর্যটকদের জন্য হাতি ঘোড়া ইত্যাদির ব্যাবস্থা করেছে। অনেকের ধারনা এ দ্বীপের বালুকাবেলায় কোন অবকাঠামো গড়ে তুললে সমুদ্রের জোয়ারে তা ভেঙ্গে পড়তে পারে। তবে বিকল্প ব্যবস্থায় পি-ফেব্রিকেটেড কটেজ নির্মাণ করে পর্যটন মৌসুমে এর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বন বিভাগে একটি নির্দিষ্ট এলাকাকে চিহ্নিত করে অভয়ারন্য হিসাবে ঘোষণা করে এর ভিতর ছোট ছোট চ্যানেলে পর্যটকদের জন্য দৃশ্য অবলোকনের ব্যবস্থা করতে পারে। যেভাবে দেশী বিদেশী বিভিন্ন পর্যটক এ দ্বীপের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে, এ আগ্রহকে কাজে লাগিয়ে এখানে গড়ে উঠতে পারে অত্যন্ত আকর্ষণীয় পর্যটন জোন। এ থেকেও আমাদের দেশ উপার্জন করতে পারে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্র।



প্রাকৃতিক স্বাস্থ্য নিবাসঃ
ইতিমধ্যে নিঝুম দ্বীপটি হয়ে উঠেছে একটি চমত্কার স্বাস্থ্য নিবাস। যে কেই এখানে এসে সুন্দর সূর্যস্নাত দিনে সমুদ্র অবগাহনে হবেন পুলকিত। বছরের ঝূঁকিপূর্ণ ঝড় ঝঞ্ঝার দিনগুলো বাদে বিশেষ করে শীত-হেমন্তে ভ্রমন বেশ জমে উঠে। এখানে শহরের মত গাড়ীর ধোঁয়া নেই। ধুলি বালির আধিক্য নেই। কান ফাটা গাড়ীর হর্ন নেই। কেবল সমুদ্রের নির্মল বায়ু শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশ, বায়ু পরিবর্তনকারীদের জন্য এ দ্বীপটি এক স্বর্গরাজ্য। মাত্র কয়েক ঘন্টার অবস্থানেই শরীর ও মন হয়ে উঠবে ঝরঝরে তাজা।

মত্স্য ভান্ডারঃ
নিঝুম দ্বীপের চতুর্দিকে আছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বিশাল মৎস্য ভান্ডার। বৈশাখ থেকে আষাঢ় শ্রাবণ পর্যন্ত এখানে সবচেয়ে বেশী মাছ ধরা পড়ে। এ সময় সবচেয়ে বেশী ধরা পড়ে ইলিশ। ইলিশ ছাড়াও নানান জাতের মাছ সারা বছরই এখানে পাওয়া যায়। খুলনা, বরিশাল, চাঁদপুর, চট্টগ্রামের শত শত মাছ ধরার ট্রলার এ সময় এ অঞ্চলে এসে মাছ ধরে নিয়ে যায়। এ সময় নিঝুম দ্বীপের চতুর্দিকে হাজার হাজার জেলেদের পাল তোলা নৌকা মাছ ধরার উৎসবে মেতে উঠে। নানা রঙের নানা আকারের পালের নৌকার সাগরের মধ্যে এক রঙ্গিন ফুলের মালায় পরিনত হয়। সে দৃশ্য স্বচে না দেখলে কল্পনা করাও অসম্ভব।

সমুদ্রের কলতান, মায়াবী হাতছানীঃ
সমুদ্রের ডাক শুনতে সবাই ছুটে যায় কক্সবাজার। সমুদ্র সৈকত বলতে বুঝায় কক্সবাজার টেকনাফ এবং স¤প্রতিক কুয়াকাটা। অথচ নিঝুম দ্বীপের বিস্তীর্ণ সমুদ্রতট ও তার মায়াবী হাতছানী এখনো অনেকের আড়ালে রয়ে গেছে। অদ্ভুত এক নির্জনতা নিঝুম দ্বীপকে ঘিরে রেখেছে এর সৈকতে দাঁড়ালে গভীর সমুদ্র থেকে তরঙ্গে ভেসে আসে সমুদ্রের মায়াবী আহ্বান। হৃদয়ে বেজে উঠে অপূর্ণ সুরের মুর্ছনা। তনুমন তখন তন্ময় হয়ে হারিয়ে যায় সুদূর দিগন্তে। যেন সাগরের নীলে দাঁড়িয়ে আকাশের নীলকে ছুঁয়ে দেখা। সমুদ্রের হৃদপিন্ডে বসে সমুদ্রের শব্দ শোনা। আর মনের সাধ মিটিয়ে বেড়াতে চাইলে নিঝুম দ্বীপ হচ্ছে আদর্শ স্থান। সমুদ্রের গানের সাথে নিজ হৃদয়ের সুর মিলিয়ে একাকার হয়ে যাওয়া, দূরনীলিমায় আকাশ রাঙানো দিগন্তের ফুলসজ্জায় সূর্য আর সাগরের অপূর্ব মৈথুন উপভোগ করা। পরক্ষনেই উর্মিল সাগরের জলদ শরীরে লাল সূর্যের হারিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে যে কারো রোমান্টিক হৃদয়কেও নিরুদ্দেশ করে দেবে
যেভাবে নিঝুম দ্বীপ যাওয়া যাবেঃ
ঢাকা থেকে খুব সহজেই নিঝুম দ্বীপ যাওয়া যায়। ঢাকার সদরঘাট থেকে একটি স্টিমার সপ্তাহে দুদিন হাতিয়ায় চলাচল করে। হাতিয়া থেকে ট্রলারে যেতে হয় নিঝুম দ্বীপ। ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে প্রতিদিন ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে রাত পর্যন্ত অনেকগুলো চেয়ারকোচ সরাসরি নোয়াখালীতে যাতায়ত করে। চার থেকে সাড়ে চার ঘন্টায় এগুলো সরাসরি মাইজদী সোনাপুর এসে পৌঁছে। চেয়ার কোচের ভাড়া দুইশ' টাকা । সকাল সাতটায় কমলাপুর থেকে ছাড়ে উপকূল এক্সপ্রেস ট্রেন । এছাড়া ঢাকা সাঈদাবাদ থেকে আধা ঘন্টা পর পর যাত্রীসেবা বাস গুলো ছাড়ে নোয়াখালীর উদ্দেশ্যে, ভাড়া ১শ ২০ টাকা। নোয়াখালী সোনাপুর পৌঁছে সেখান থেকে যেতে হবে স্টিমার ঘাট। বাস টেম্পো বা বেবীতে সরাসরি পাকা মশ্রিণ পথ ধরে ৪০ কিঃমিঃ দক্ষিণে সুধারামের শেষ প্রান্তে চর মজিদ স্টিমার ঘাট। তার পরেই হাতিয়া যাবার চেয়ারম্যান ঘাট। পাকা রাস্তা একেবারে ঘাট পর্যন্ত এসে মিশেছে। সোনাপুর থেকে একটি বেবী রিজার্ভ নিলে ২৫০টাকা থেকে ৩০০ টাকা অথবা জনপ্রতি ৫০টাকা দিয়ে যাওয়া যায়। টেম্পো, বাসে জনপ্রতি ভাড়া আরো কম। চর মজিদ ঘাট থেকে ট্রলার কিংবা সী-ট্রাকে করে হাতিয়া চ্যানেল পার হয়ে যেতে হবে হাতিয়া নলচিরা ঘাটে। সময় লাগে প্রায় দুই ঘন্টা। । নলচিরা বাজার থেকে যেতে হবে হাতিয়ার দক্ষিণে জাহাজমারা। সময় নেবে আধা ঘন্টা। জাহাজমারা থেকে ট্রলারে সরাসরি নিঝুম দ্বীপ। সময় নেবে ৪০/৫০মিনিট। তবে দলবেঁধে গেলে ট্রলার রিজার্ভ করে সরাসরি নিঝুম দ্বীপ যাওয়া যায়। ঘাট থেকে নদীপথে হাতিয়া অথবা নিঝুম দ্বীপে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে জোয়ারের জন্য। কারণ জোয়ার না থাকলে ঘাটে ট্রলার ভিড়ানো যায় না। আবার ভাটার সময় নদীতে অসংখ্যা ডুবা চরে ট্রলার আটকে যাবার সম্ভাবনা থাকে। জোয়ারের সঠিক সময় জেনে ঢাকা থেকে ভোরে রওনা হলে বিকালের মধ্যে নিঝুম দ্বীপে পৌছানো যায়। নিজস্ব গাড়ী নিয়ে আসলে ঢাকা থেকে মাত্র সাড়ে তিন থেকে চার ঘন্টায় সহজেই স্টিমার ঘাটে পৌঁছা যাবে। পথিমধ্যে যোগাযোগের এই সামান্য অসুবিধা ছাড়া এত অল্প সময় ও অল্প খরচে সমুদ্রের কাছে যাওয়ার আর কোন সহজ উপায় নেই।

থাকার ব্যবস্থাঃ
নিঝুম দ্বীপে অতি স¤প্রতি একটি ভালোমানের হোটেল বাণিজ্যিক ভাবে চালু হয়েছে। এখানকার স্থানীয় বাজারে খুব সস্তায় অল্প দামে চার পাঁচটি আবাসিক বোডিং আছে। তাছাড়া বন বিভাগের একটি চমৎকার বাংলো আছে। পাশেই আছে জেলা প্রশাসকের ডাক বাংলো। এগুলোতে আগে ভাগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে থাকার ব্যবস্থা করা যায়। তাছাড়া রেড-ক্রিসেন্ট ইউনিট ও সাইক্লোন সেন্টারেও থাকার ব্যবস্থা করা যায়। এ দ্বীপে অনেকেই আছেন খুব বন্ধু বত্সল। পর্যটকদের এরা খুব সম্মানের চোখে দেখেন। যেকোন অসুবিধা দুর করতে আগ্রহ করে তারা নিজেরাই এগিয়ে আসেন। নোয়াখালী শহরে থাকতে চাইলে এখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি ভাল ভাল আবাসিক হোটেল। প্রধান সড়কের পাশেই এই হোটেল গুলো রয়েছে। তাছাড়া বিআরডিবি রেস্ট হাউস, সড়ক বিভাগ, জনস্বাস্থ্য বিভাগের আধুনিক ডাক বাংলো রয়েছে। সরকারী অনুমতি নিয়ে সার্কিট হাউসেও যে কেউ থাকতে পারেন। সময় করে মাইজদীতে একদিন থেকে এর শান্তরূপ উপভোগ করা হবে ভ্রমনের একটি বাড়তি পাওনা। পথে পড়বে বিখ্যাত মোঘল স্থাপত্যের নান্দনিক সৌন্দর্যের বজরা মসজিদ। আর একটু সময় নিলে দেখে আসা যাবে অহিংস ভাবাদর্শের নানান ঘটনা বিজড়িত উপ মহাদেশ খ্যাত গান্ধি আশ্রম।

নিঝুম দ্বীপের রোমাঞ্চঃ
যারা উচ্ছাস উচ্ছলতা আর রোমাঞ্চে জীবনকে অর্থবহ করতে চান তারা নিঝুম দ্বীপকে ঘিরে, সে আশা ষোলকলা পূর্ণ করতে পারেন। শীত মৌসুমে সাগর শান্ত থাকলেও বছরের যেকোন সময় এখানে আসা যায় এপ্রিল থেকে সাগর ধীরে ধীরে অশান্ত বা গরম হতে থাকে। তখন ঢেউয়ের উচ্চতাও বৃদ্ধি পায়। ট্রলারে সে তরঙ্গ বিক্ষুদ্ধ সাগর পাড়ি দিতে প্রয়োজন পড়ে সাহসের। সে সময় এক রোমাঞ্চ অভিজ্ঞতায় দুধর্ষ অভিযাত্রীর মত মনে হবে নিজেকে। উদ্দাম ঢেউয়ে ছিটকে আসা সমুদ্রের লোনা জল পুলকিত হবে হৃদয়। এ সময় সমুদ্র পাড়ি হবে জীবনের রোমাঞ্চাকর হৃদ-কাঁপানো অভিজ্ঞতা। এ অভিজ্ঞতার ভান্ড ভারী হলে জীবনও হবে সমৃদ্ধশালী।


নিঝুম দ্বীপ। সে এক অজানা মায়াবী রহস্য দ্বীপ। ধীরে ধীরে অবগুষ্ঠন খুলে উন্মোচন করছে নিজেকে। দূর সমুদ্র থেকে হাতছানি দেয় সে। চপলা লাস্যময়ী কুমারীর মত ইশারায় কাছে ডাকে। যাদের সৌভাগ্যের দেবী সুপ্রসন্ন হবে তারাই ছুটে যাবে সাগর সঙ্গমে।

মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ
গবেষক, সাংবাদিক
পুরাতন হাসপাতাল সড়ক
মাইজদী কোর্ট, নোয়াখালী
ফোন: ০১৭১১২২৩৩৯৯
e-mail: mhfoez@gmail.com