স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা #### মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ

খাদ্যসার্বভৌমত্ব

খাদ্যসার্বভৌমত্ব
মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ
বেঁচে থাকার জন্য আমাদের খাদ্যের প্রয়োজন। খাদ্য একদিকে আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখে, রোগ শোক থেকে রক্ষা করে, অন্যদিকে খাদ্য আমাদের নিজস্ব জীবন যাপন এবং সংস্কৃতিরও ধারক ও বাহক। মানবজাতির আদি সভ্যতার সূতিকাগার হোলো কৃষি । মানুষ প্রথম সভ্যতার বীজ বপন করে শষ্য উৎপাদনের মাধ্যমে। সে তার নিজস্ব প্রয়োজনে নিজস্ব আঙ্গিকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য খাদ্য উৎপাদন শুরু করেছিলো। মানুষের সভ্যতার সাথে সাথে কৃষির শতস্ফুর্ত সভ্যতাও সমান্তরাল ভাবে এগিয়ে গেছে। এই কৃষি সভ্যতার সামান্য বত্যয় ঘটলে মানুষের সভ্যতারও বত্যয় ঘটে। কৃষিকে ক্ষতিগ্রস্থ কিংবা অবজ্ঞা করে কোনো সভ্যতা টিকে থাকতে পারেনা । আমরা দেখতে পাই আদিকাল থেকে এই কৃষি উত্পাদনের সাথে মানুষের মূল্যবোধ ও একটি দর্শনও জড়িত রয়েছে । এটা হোলো সে শুধু তার নিজের জন্যই উত্পাদন করেনা সে তার জনগোষ্ঠীর জন্যও খাদ্য উৎপাদন করে। খাদ্য গ্রহন করে সে যেমন নিজে বেঁচে থাকে আবার অপরকেও বাঁচিয়ে রাখে। সুতরাং এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা যায় ,খাদ্য উত্পাদনের সাথে মুনাফার কোনো সম্পর্ক নেই। এখানে জড়িত রয়েছে এক গভীর মুল্যবোধের প্রশ্ন। এ মুল্যবোধই তাকে মানুষ হিসাবে চিহ্নিত করে দেয়। মানুষ একই সাথে তার নিজের খাদ্য উত্পাদন করে এবং অন্যান্য প্রাণীর খাদ্যও সে নিশ্চিত করে। খাদ্যের সার্বভৌমত্ব হোলো নিজের খাদ্য নিজে উৎপাদন করা এবং সেই খাদ্য উৎপাদনের প্রকৃয়া নিজের নিয়ন্ত্রনে রাখা। এর জন্য তার পরিবেশের দিকেও তাকে নজর রাখতে হয়। তাই কৃষি উৎপাদন শুধু খাদ্য উত্পাদনই নয় এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে প্রকৃতি প্রতিবেশ পরিবেশ এবং অন্যান্ন প্রাণী জগতের সাথে নিবীড় সম্পর্ক। এ সমস্ত কিছুর সাথে সম্পর্ক রেখেই খাদ্য উত্পাদন করে মানুষের সভ্যতা চলমান রয়েছে। খাদ্যে সার্বভৌমত্ব হচ্ছে কৃষকের নিজ এলাকার পরিবেশ,সংস্কৃতি ও কৃষি পদ্ধতির সাথে সঙ্গতি রেখে উৎপাদন ও জনগনের খাদ্য পাবার অধিকার । এই অধিকারের মধ্যে নিরাপদ,পুষ্টি সম্মত এবং নিজ সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল খাদ্যের কথা আছে । খাদ্যে সার্বভৌমত্বের অধিকার একই সাথে জমি পানি বীজ এবং সকল প্রাকৃতিক সম্পদেরও অধিকার বুঝায়। কৃষিতে নারীর অবদান এবং সক্রিয় অংশগ্রহনের সম্পূর্ন স্বীকৃতিও এর সঙ্গে বুঝায়। কিন্তু বর্তমানে কর্পোরেট পুঁজির ব্যবস্থাপনায় কৃষি একটি শিল্প কারখানায় পরিণত হয়েছে। বহুজাতিক কোম্পানীর মুনাফার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে কৃষি। এর ফলে এই অধিকার এখন খর্ব হতে বসেছে। যদিও খাদ্যে সার্বভৌমত্ব মৌলিক অধিকার হিসাবে বহু আন্তর্জাতিক সনদে স্বীকৃত কিন্তু তবুও বিশ্বের বহু দেশ এবং এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের পঞ্চাশ কোটি লোক যারা কৃষক ও সরাসরি উৎপাদক হিসাবে কাজ করছে তারা পুষ্টি হীনতার শিকার। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে এই চিত্র খাদ্য ঘাটতির কারনে হচ্ছে না বরং কৃষক ও গরিব মানুষ সহ খাদ্য উৎপাদক গোষ্ঠীর জমি সম্পদে অধিকার নেই । ফাও মনে করে এর প্রধান কারন খাদ্য সরবরাহে ত্র“টি ও সময় সঠিক মত খাদ্য পাচ্ছেনা বলেই ঘটছে।২০০২সালে জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষিসংস্থা (ফাও) আয়োজিত বিশ্ব খাদ্য সম্মেলন +৫-এ বিশ্বের সরকার এবং রাষ্ট্র প্রধানরা ২০১৫ সালের মধ্যে ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরূদ্ধে একটি অঙ্গীকার ও প্রস্তাব গ্রহন করেছে । অনেকেই মনে করছেন তা বাস্তবে একটি অবাস্তব প্রস্তাব। ক্ষুধা ও অপুষ্টি বানিজ্য উদারিকরনের ফলেই ঘটছে। বিশ্ব ব্যংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আই এম এফ) এর বানিজ্য উদারিকরনের কাঠামোগত সংস্কার কর্মসূচী এশিয়ার গরিব ঋনগ্রস্ত দেশগুলোকে কৃষি ক্ষেত্রে বানিজ্য নীতি ও উদারিকরনের আওতায় আনার জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। এরফলে কৃষক, আদিবাসী জনগোষ্ঠী,নারী ও শিশু সহ সাধারন মানুষ দিনের পর দিন মৃত্যুর মুখে ধাবিত হচ্ছে। যতদিন পর্যন্ত এ অবস্থার পরিবর্তন করা না হবে তত দিন পর্যন্ত ক্ষুধা দারিদ্র অপুষ্টি থাকবেই। বিশ্ব বানিজ্য সংস্থার খোলা বানিজ্যনীতি এবং গোলকায়নের নানান কৌশল তৃতীয় বিশ্বের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রনহীন করে তুলছে। যারফলে কোটি কোটি ক্ষুদ্র কৃষক ভূমিহীন চাষী ক্ষেতমুজুর এবং আদিবাসী জনগন এখন জমি পানি এমনকি তাদের বেঁচে থাকার নূন্যতম সুয়োগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শুধু তাই নয় ফলে খাদ্য উৎপাদনে মানুষের অধিকার মারাত্বক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে । জাতীয় এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে খাদ্য সার্বভৌমত্বের চরম হুমকীর সম্মুখীন হয়ে পড়েছে।এশিয়ার বিভিন্ন দেশের কৃষকদের সংগঠনগুলো এই সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ গড়ে তুলছে। দক্ষিন এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ভুমিকা পালন করছে ভারত ও বাংলদেশ। কৃষিতে বিষের ব্যবহারের বিরুদ্ধে অন্তর্জাতিক পর্যায়ে আন্দোলন গড়ে তুলছে মালয়শিয়ার পেষ্টিসাইড একশান নেটওয়ার্ক (প্যন-এপি)। ২০০৪সালের ২৫-২৭ নভেম্বর ঢাকার ওসমানী মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের খাদ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করবার জন্য অন্তর্জাতিক সম্মেলন। এতে বাংলাদেশ ও ভারত সহ প্রশান্ত মহাদেশীয় অঞ্চল ছাড়াও পৃথিবীর ৩৭টি দেশের ২০০ প্রতিনিধি অংশ গ্রহন করে। এই সম্মেলনের আয়োজনে ছিলো দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে খ্যাতি সম্পন্ন গবেষনা প্রতিষ্ঠান উবিনীগ (উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষনা )। এই সম্মেলনের গুরূত্ব ব্যখ্যা করে উদ্বোধনী বক্তব্য দেন উবিনীগের নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আক্তার এবং এশিয়া প্যাসিফিক রিসার্স নেটওয়ার্ক -এর বোর্ড কনভেনর ইনু রেইকো। তিনদিন ব্যপী এই সম্মেলনে খাদ্যসার্বভৌমত্বের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বক্তব্য রাখেন উবিনীগের চেয়ারম্যান ফরহাদ মজহার, মালয়েশিয়ার সরোজিনী রেঙ্গম, কানাডার প্যাট মুনি, ফিলিপাইনের টনি টুহান ও র‌্যাফেল মারিয়ানা, পাকিস্তানের শহীদ জিয়া, নিউজিল্যান্ডের জেইন কেলসি, ভারতের পি.ভি.সতীশ প্রমূখ নেতৃবৃন্দ। এই সম্মেলনে বিভিন্ন চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গ খাদ্যসার্বভৌমত্বের বিষয়ে স্পষ্ট ধারনা দিতে চেষ্টা করেছেন।অধিক খাদ্য উৎপাদনের সস্তা বুলি আউড়িয়ে বহুজাতিক কোম্পানী গুলো কৃষিতে সার ও কীটনাশক ব্যবহার করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছে। এর সহায়ক শক্তি হচ্ছে বিশ্ব ব্যংক ও এশিয়ান উন্নয়ন ব্যংক। কৃষিতে সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে খাদ্য বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। এই বিষাক্ত খাদ্য গ্রহন করে মানুষ দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছে। অপর দিকে শহর গঞ্জ গ্রামে বেঙের ছাতার মত প্রাইভেট ক্লিনিক হাসপাতাল গড়ে উঠছে। বিশ্বায়নের মাধ্যমে মহাদেশীয় কর্পোরেশন গুলি ফায়দা লুটছে। তারা কৃষি কেমিক্যালস বীজ ও খাদ্য শিল্পের ব্যপারে কৌশল নির্ধারন করছে ও এক চেটিয়া ব্যবসায়িক প্রভাব বিস্তার করছে। এতে অপ্রয়োজনীয় ক্ষতিকর কৃষি সামগ্রী অবাধে বিক্রি হচ্ছে। স্থানীয় ভাবে খাদ্য উত্পাদনে গুরুত্ব হারাচ্ছে। তারা বিশেষ করে গরীব দেশে দেশে অবাঞ্ছিত ভাবে খাদ্য মওজুদ গড়ে তুলছে। কৃষি শিল্পের প্রসারের সাথে সাথে এবং রপ্তানীমুখী শষ্য উৎপাদনের ফলে অধিকতর কীটনাশক ব্যবহার হচ্ছে। ফলশ্র“তিতে কৃষক শ্রমিক ভোক্তা বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে এবং আমাদের খাদ্য, জমি, বাতাস ও পরিবেশ বিষাক্ত হচ্ছে।মহাদেশীয় কর্পোরেশন গুলি জেনেটিক ভাবে উদ্ভাবিত অনুজীব, বীজ ও খাদ্য বিপননের ফলে জনস্বাস্থ্য জীববৈচিত্র্য পরিবেশ ও জীবন ধারনের ব্যপারে নতুন হুমকী হয়ে দেখা দিয়েছে। এই প্রযুক্তি ভুল ও অনৈতিক বিপনন দ্বারা ভিত্তি স্থাপনের মাধ্যমে কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনের উপর আধিপত্ত বিস্তার করবে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও পেটেন্ট ‘ল’ বীজ সংরক্ষনের অন্তরায় যা জনগনের খাদ্য সার্বভৌমত্বের জন্য সমস্যা। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে উদ্ভাবিত ধান আঞ্চলিক খাদ্য সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকী। জমি হচ্ছে খাদ্য, জীবন যাত্রা ও সংস্কৃতির উৎস। বিবেক বর্জিত বৃহদাকার জমির মালিক ও মহাদেশীয় কর্পোরেশন গুলি সরকারের সাহায্যে বানিজ্য উদারনীতি রপ্তানী মূলক খাদ্য ও খাদ্য উৎপাদনে বিকল্প জমি ব্যবহারের ফলে ক্ষুদ্র চাষিগন ও তাদের পরিবার বর্গ জমি হতে বিতাড়িত হচ্ছে। এভাবে জমি দখলও ত্বরান্বিত হচ্ছে। একে একে হারিয়ে যাচ্ছে খাদ্য স্বয়ংসম্পুর্ণতা, আদি শিক্ষা ব্যবস্থা, বীজ ও প্রাণ বৈচিত্র্য। জমি থেকে কৃষক উচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে। মৎসজীবীরা হারাচ্ছে তাদের জীবন ও জীবিকা। জল ও নদী থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে এক বিশাল জন গোষ্ঠী। মহিলারা অধিক হারে দুর্দশাগ্রস্থ হয়ে পড়ছে। অবাধে হচ্ছে সামরিকীকরন। অমানবিক ভাবে হচ্ছে মানব অভিবাসন। বাড়ছে ক্ষুধা ও পুষ্টিহীনতা। ভূমি হীনের সংখ্যা আশংকা জনকভাবে বাড়ছে। এসবের জন্য সচেতন মহল গভীরভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে। এখন পৃথিবী ব্যাপী দাবী উঠছে খাদ্য সার্বভৌমত্বের নিশ্চয়তার জন্য। যে সব দাবী গুলো এখন খুবই সোচ্চার সে গুলো হলো-১.সঠিক ভূমি বন্টন নীতি যা ভূমিহীন ও ক্ষুদ্র চাষি কৃষক পরিবারের ছেলে মেয়ে উভয়েই যারা জমিতে কাজ করে বা পূর্বে উৎখাত হয়েছে সকলকে কৃষি উত্পাদনে সাহায্য প্রদান সহ মহাদেশীয় কর্পোরেশনের প্রভাব মুক্ত রাখা অপরিহার্য। সঠিক ভূমি বন্টন নীতিই কেবল খাদ্য সার্বভৌমত্ব, জমি ও খাদ্য বিষমুক্ত এবং সামাজিক ন্যয় বিচারের ভিত্তি স্থাপন করতে পারে। ২.কৃত্রিম কীটনাশক যা স্বল্পমেয়াদি অথবা দীর্ঘমেয়াদি এন্ডোক্রাইন জনিত ক্ষতির কারন হতে পারে তার ব্যাবহার নিয়ন্ত্রন হৃাস বা পর্যায়ক্রমে সম্পূর্ন নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন।৩. কর্পোরেশন গুলিকে নিষ্কৃয় করা সহ কীটনাশক বিরোধী আন্দোলনকারীকে সরকার কতৃক হয়রানী ব›দ্ধ করা আবশ্যক। কীটনাশক ব্যবহারের ফলে ক্ষতিগ্রস্থদের ক্ষতি পূরনের ব্যবস্থা করা দরকার ।৪.ভোক্তা এবং উৎপাদক উভয়ের পক্ষ হতেই জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের (জি,এম) মাধ্যমে উদ্ভাবিত বীজ খাদ্য এবং কৃষিতে অনুজীবের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। অনতিবিলম্বে জি.এম. খাদ্য সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে।৫.কর্পোরেট ও সরকারের জবাবদিহিতা সহ এ্যগ্রো কেমিক্যাল এবং খাবারের উপর যে অন্যায় কর্মকান্ড প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার সকল প্রকার অন্যায়ের অবসান করতে হবে।এখন খাদ্যের এ বিষাক্ত আগ্রাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য পৃথিবীর মানুষ মুক্তির পথ খুঁজছে। মানবজাতির আগামী সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এখন জরুরী হয়ে পড়েছে খাদ্য সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন। সবার আগে প্রয়োজন পৃথিবীকে বিষ মুক্ত করা।